বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবৈধ পণ্য পাচার প্রতিরোধে অভিযান জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এরই ধারাবাহিকতায় কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্তে পরিচালিত বিশেষ অভিযানে প্রায় ২ কোটি ১১ লাখ ৫ হাজার টাকার ভারতীয় অবৈধ পণ্য জব্দ করেছে ৬০ বিজিবি ব্যাটালিয়ন।
শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) দিনব্যাপী চলা এ অভিযানে বিজিবি সদস্যরা ভারতীয় শাড়ি, বাসমতি চাল ও একটি পিকআপভ্যানসহ বিপুল পরিমাণ পণ্য জব্দ করেন। এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন কুমিল্লা সেক্টরের সুলতানপুর ব্যাটালিয়নের (৬০ বিজিবি) সদস্যরা।
অভিযানের বিবরণ
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সীমান্তবর্তী কসবা ও ব্রাহ্মণপাড়ার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক স্থানে অভিযান পরিচালিত হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত অভিযানে বিজিবি সদস্যরা প্রথমে ব্রাহ্মণপাড়ার সীমান্তঘেঁষা কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি চালান। পরবর্তীতে কসবায় প্রবেশের পথে একটি পিকআপভ্যানে ৪০ লাখ ৯৫ হাজার টাকা মূল্যের ভারতীয় বাসমতি চাল জব্দ করা হয়।
এ ছাড়া অভিযানে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার উন্নতমানের ভারতীয় শাড়ি উদ্ধার করা হয়, যেগুলো পাচারকারীরা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসছিল। এসব পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
বিজিবির কঠোর অবস্থান
৬০ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. জিয়াউর রহমান জানান, সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান চক্র আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে বিজিবি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে।
তিনি বলেন,
“সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি সর্বদা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্টে টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। অবৈধ পণ্য আটক ও পাচারকারীদের শনাক্ত করতে বিজিবির বিশেষ অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
অধিনায়ক আরও জানান, বিজিবির সদস্যরা দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ নিয়ে সীমান্তে কাজ করছেন। তারা শুধু পণ্য চোরাচালান নয়, অস্ত্র, মাদক ও মানবপাচার প্রতিরোধেও সমান তৎপর।
চোরাচালান রোধে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি
বিজিবি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা সেক্টরের সীমান্ত এলাকায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারতীয় পোশাক, মসলা, তামাক, মদ ও চালের অবৈধ পাচার বেড়ে গেছে।
এ কারণে বিজিবি বিশেষ নজরদারি চালাচ্ছে এবং সীমান্তের অবৈধ রুটগুলোতে মোবাইল টহল দল নিয়োজিত করা হয়েছে।
বিজিবি জানায়, জব্দকৃত সব পণ্যের আনুমানিক বাজারমূল্য ২ কোটি ১১ লাখ ৫ হাজার টাকা। আইনানুগ প্রক্রিয়া শেষে এসব পণ্য বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
চোরাচালান প্রতিরোধে জনসচেতনতার আহ্বান
অভিযানের পর বিজিবি স্থানীয় জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান বলেন,
“চোরাচালান শুধু অর্থনীতির ক্ষতি করে না, বরং স্থানীয় বাজার ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে এবং দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে। তাই সাধারণ মানুষকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকার জনগণকে যদি চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত কারও সম্পর্কে তথ্য জানা থাকে, তবে তা নিকটস্থ বিজিবি ক্যাম্প বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও জাতীয় নিরাপত্তা
অর্থনীতিবিদদের মতে, সীমান্তপথে ভারতীয় পণ্য পাচার বাংলাদেশি বাজারে রাজস্ব ক্ষতি ও বৈষম্যমূলক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে। এ কারণে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কঠোর অবস্থান জাতীয় অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভারতীয় পোশাক ও চালের অবৈধ আমদানি প্রতিরোধ করতে পারলে প্রতি বছর সরকারের রাজস্ব আয় বাড়তে পারে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
বিজিবির এই সফল অভিযান কেবল অবৈধ পণ্য আটক নয়, বরং সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারেরও প্রতিফলন। চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ও নিয়মিত অভিযান চালু থাকলে সীমান্তের অবৈধ বাণিজ্য অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিজিবির এই ধরনের পদক্ষেপ তাই কেবল একটি আইন-শৃঙ্খলা বিষয় নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
