দেশজুড়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ এখনও উদ্বেগজনক মাত্রায় থাকলেও গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুহীন সময় পার করেছে বাংলাদেশ। তবে এ সময়ে নতুন করে আরও ৫১০ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম।
শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকায় আক্রান্তের হার এখনো দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি।
কোন অঞ্চলে কতজন ভর্তি
বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে—
- বরিশাল বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ভর্তি হয়েছেন ৬৫ জন,
- চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ৮৮ জন,
- ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ১৮১ জন,
- ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ১১৬ জন,
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৩৬ জন,
- এবং ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ২৪ জন।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৫২৬ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন।
চলতি বছরের পরিসংখ্যান
চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে মোট ৫৮ হাজার ২৮০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ নারী।
এ সময় পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৩৬০ জন রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন।
যদিও ২৪৩ জনের জীবন কেড়ে নিয়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস।
তবে আশার বিষয়, গত ২৪ ঘণ্টায় কোনো মৃত্যু ঘটেনি, যা সাম্প্রতিক সময়ে তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক একটি দিক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পূর্ব বছরের তুলনা
২০২৪ সালের একই সময়ে দেশে মোট ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫৭৫ জন।
তুলনামূলকভাবে ২০২৫ সালে আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি “সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে” এমন বলা যাবে না, কারণ বর্ষা-পরবর্তী মৌসুমেও মশাবাহিত রোগটির প্রকোপ অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন আর শুধু বর্ষাকেন্দ্রিক রোগ নয়; বরং সারাবছরই এর সংক্রমণ ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ ও মশার প্রজননস্থল নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল ইসলাম বলেন,
“ডেঙ্গুর সংক্রমণ এখন ‘এন্ডেমিক’ বা স্থানীয়ভাবে স্থায়ী প্রকৃতির হয়ে উঠছে। শুধু আক্রান্তের সংখ্যা নয়, আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত সংক্রমণের বিস্তাররোধ ও ভেক্টর ম্যানেজমেন্টে।”
তিনি আরও বলেন, আক্রান্তদের অধিকাংশই হালকা জ্বরে আক্রান্ত হলেও অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত অবনতি ঘটে; তাই সামান্য উপসর্গেও চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
কর্তৃপক্ষের আহ্বান
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে—
- ঘরের ভেতর ও বাইরে জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখতে,
- ফুলের টব, টিনের ছাদ, পুরনো টায়ার, ড্রাম ইত্যাদিতে পানি না জমতে দিতে,
- এবং শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে।
এছাড়া, প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মশা নিধন অভিযান ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সতর্কতার সময় এখনই
যদিও মৃত্যুহীন ২৪ ঘণ্টা কিছুটা আশার ইঙ্গিত দিয়েছে, তবু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই আত্মতুষ্টির সময় নয়। ডেঙ্গুর ঋতুচক্র ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে—বর্ষা শেষে অক্টোবর-নভেম্বরেও সংক্রমণ বাড়ছে।
সুতরাং, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার না করলে আগামী সপ্তাহগুলোতেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি নতুন করে জটিল আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ডেঙ্গুর সংক্রমণ গত বছরের তুলনায় খানিকটা নিয়ন্ত্রিত হলেও মৃত্যুর সংখ্যা এখনও উদ্বেগজনক। নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা এবং সচেতনতার অভাবই এ রোগের বিস্তারে প্রধান বাধা হয়ে আছে।
নাগরিক উদ্যোগ ও সরকারি সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়—এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
