বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তবন্দর সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কাস্টমস হাউজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গত মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
এ ঘোষণার মাধ্যমে দেশের বাণিজ্য প্রশাসনের কাঠামোয় ভোমরা স্থলবন্দর একটি নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছে। এখন থেকে খুলনা কাস্টমস হাউসের অধীনে নয়, বরং নিজস্ব প্রশাসনিক ক্ষমতায় ভোমরা কাস্টমস হাউজ নিজেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করবে—যেমন শুল্ক নির্ধারণ, রাজস্ব আদায়, আমদানি-রপ্তানি নথি যাচাই, এবং পণ্য ক্লিয়ারেন্স সংক্রান্ত প্রক্রিয়া।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই পদক্ষেপকে দেশের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের এক ‘গেম চেঞ্জার’ বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী ও বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাণিজ্যে নতুন গতি
ভোমরা স্থলবন্দর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিদিন শত শত পণ্যবাহী ট্রাক এই বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পণ্য আদান–প্রদান করে।
নতুন এই প্রশাসনিক মর্যাদার ফলে বন্দর কার্যক্রম আরও দ্রুত, স্বচ্ছ ও দক্ষ হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
ভোমরা কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আবু হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মো. আবু মুছা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন,
“অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা উচ্ছ্বসিত। এখন থেকে সময় ও খরচ দুই-ই বাঁচবে, এবং বাণিজ্য আরও গতিশীল হবে।”
তারা আরও জানান, এত দিন খুলনা কাস্টমস হাউসের মাধ্যমে ভোমরার প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হতো। এতে সময় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি কাগজপত্র যাচাইয়ের জটিলতা দেখা দিত। কিন্তু এখন স্থানীয়ভাবে সব কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় ব্যবসায়ী ও পণ্য পরিবহনের গতিও বাড়বে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও সম্ভাবনা
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোমরাকে কাস্টমস হাউজ হিসেবে উন্নীত করার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রাজস্ব আয়, বাণিজ্য প্রবাহ এবং রপ্তানি সুযোগ বহুগুণে বাড়বে।
বাণিজ্য বিশ্লেষক ড. ফরিদুল ইসলাম বলেন,
“ভোমরা হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্য প্রবেশদ্বার। এটি কাস্টমস হাউজ হওয়ার ফলে দেশের সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আরও বিকেন্দ্রীভূত হবে, যা প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াবে এবং সীমান্ত অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করবে।”
বর্তমানে ভোমরা দিয়ে প্রধানত ভারত থেকে আমদানি হয় খাদ্যপণ্য, নির্মাণসামগ্রী, পোশাক, কসমেটিকস, ও কৃষিপণ্য। অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় মাছ, চিংড়ি, কৃষিপণ্য, এবং হালকা শিল্পজাত দ্রব্য।
প্রতি বছর এই বন্দর দিয়ে হাজার কোটি টাকার পণ্য বাণিজ্য হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাস্টমস হাউজে উন্নীত হওয়ার ফলে এখন রাজস্ব আদায় ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে।
প্রশাসনিক পরিবর্তন ও অবকাঠামো উন্নয়ন
‘কাস্টমস হাউজ’ ঘোষণার পর ভোমরায় নতুন করে জনবল নিয়োগ, আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ এবং তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা চালুর প্রস্তুতি চলছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কর্মকর্তা জানান,
“ভোমরায় একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে শুল্ক নির্ধারণ, রাজস্ব সংরক্ষণ, এবং বাণিজ্য পর্যবেক্ষণ আরও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা যাবে।”
তিনি আরও বলেন, কাস্টমস হাউজ হিসেবে ভোমরার ভূমিকা কেবল সীমান্ত বাণিজ্যে নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পরিবহনকর্মীরা আশা করছেন, এই উন্নীতকরণের ফলে কেবল প্রশাসনিক সুবিধাই নয়, বরং বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে। ইতিমধ্যে নতুন গুদামঘর, ট্রাক টার্মিনাল এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির বলেন,
“ভোমরার কাস্টমস হাউজ হিসেবে যাত্রা শুধু একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, বরং এটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতীক। এটি দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় এক নতুন অধ্যায়।”
বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলোর মধ্যে ভোমরা ইতোমধ্যেই কার্যক্রম ও রাজস্ব আদায়ে শীর্ষস্থানীয়। এখন ‘কাস্টমস হাউজ’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ায় এই স্থলবন্দর শুধুমাত্র প্রশাসনিক মর্যাদা নয়, বরং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
সরকার ও ব্যবসায়ী মহল উভয়ের প্রত্যাশা—এই উদ্যোগ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে জাতীয় অর্থনীতির আরও শক্তিশালী অংশে পরিণত করবে।
