ইসরাইলি বাহিনী আবারও লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোরে পরিচালিত এই হামলায় এক ব্যক্তি নিহত এবং অন্তত সাতজন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বৈরুত থেকে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপি নিশ্চিত করেছে, হামলার ঘটনাটি সীমান্তবর্তী একাধিক এলাকায় সংঘটিত হয় এবং স্থানীয় সময় রাতভর আকাশে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, পূর্বাঞ্চলীয় শ্মিস্তার শহরে একজন নিহত হন। পাশাপাশি সাইদা জেলার ব্নাফুল এলাকায় একজন এবং নাবাতিয়েহ জেলার আনসার অঞ্চলে ছয়জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
অন্যদিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা “হিজবুল্লাহ ও তার সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর সন্ত্রাসী অবকাঠামো” লক্ষ্য করে এই হামলা চালিয়েছে। এক বিবৃতিতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানায়,
“দক্ষিণ লেবাননের মাজরাত সিনাই অঞ্চলে হিজবুল্লাহর সক্রিয় ঘাঁটি ও অস্ত্রভান্ডারে নির্দিষ্ট হামলা পরিচালনা করা হয়েছে।”
তারা আরও দাবি করে, হামলায় “গ্রিন উইদাউট বর্ডারস” নামের একটি সংগঠনের ব্যবহৃত স্থাপনাও ধ্বংস করা হয়েছে। ইসরাইলের দাবি অনুযায়ী, সংগঠনটি বেসামরিক পরিবেশের আড়ালে হিজবুল্লাহর কার্যক্রম পরিচালনা করছিল।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ওই সংগঠনকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় রেখেছে।
বৈরুতের পাল্টা অভিযোগ
তবে লেবাননের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ইসরাইল বেসামরিক এলাকা লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছে—যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও যুদ্ধবিরতির সরাসরি লঙ্ঘন।
লেবাননের প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন এক বিবৃতিতে বলেন,
“ইসরাইলের বারবার আগ্রাসন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত নীতির অংশ—যার উদ্দেশ্য দেশের উৎপাদনক্ষম অবকাঠামো ধ্বংস করা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বাধা সৃষ্টি করা এবং মিথ্যা নিরাপত্তার অজুহাতে জাতীয় স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করা।”
তিনি আরও বলেন, “গত বছরের নভেম্বরে যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়েছিল, ইসরাইল সেটি লঙ্ঘন করেছে। এই হামলার মাধ্যমে তারা সরাসরি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে।”
লেবাননের মন্ত্রিসভাও এক জরুরি বৈঠকে বসে এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৭০১ নম্বর প্রস্তাব, যা ২০০৬ সালের ইসরাইল-লেবানন যুদ্ধের পর যুদ্ধবিরতির ভিত্তি স্থাপন করেছিল, সেই চুক্তি ইসরাইল বারবার ভঙ্গ করছে।
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা
গত এক বছর ধরে লেবানন সীমান্তে ইসরাইল ও ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর মধ্যে উত্তেজনা চলছেই।
নভেম্বরের যুদ্ধবিরতির আগে দুই পক্ষের সংঘর্ষ দুই মাসব্যাপী প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপ নেয়, যেখানে শতাধিক মানুষ নিহত ও হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হন।
সাম্প্রতিক এই হামলার মাধ্যমে সীমান্ত উত্তেজনা নতুন করে উসকে উঠল বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বৈরুতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রামি খালিদ বলেন,
“ইসরাইল এখন গাজা এবং দক্ষিণ লেবানন—দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের মনোভাব তৈরি করছে। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ংকর সংকেত। হিজবুল্লাহর পাল্টা হামলার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
মানবিক সংকটের আশঙ্কা
লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে ইতিমধ্যে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে শুরু করেছেন। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, গত এক মাসে সীমান্ত এলাকার অন্তত পাঁচটি গ্রাম আংশিকভাবে খালি হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,
“যে কোনো সামরিক সংঘর্ষে বেসামরিক জনগণ ও স্থাপনাকে লক্ষ্য করা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন। ইসরাইল ও হিজবুল্লাহ উভয় পক্ষকেই সংযম দেখাতে হবে।”
আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া
তুরস্ক, ইরান ও মিশর এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ইসরাইলের এমন আগ্রাসন আঞ্চলিক শান্তি প্রচেষ্টাকে বিপর্যস্ত করছে। জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূতও পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে, লেবানন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই সঙ্গে সীমান্তে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী (UNIFIL)-এর উপস্থিতি আরও জোরদারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলা কেবল সীমান্ত সংঘাত নয়—বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার অংশ। গাজায় ইসরাইলি অভিযান এবং লেবাননে নতুন হামলা—উভয়ই অঞ্চলজুড়ে অনিশ্চয়তা ও মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা আরও গভীর করছে।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited