চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আলিম পরীক্ষায় পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ, আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে এবার দেশের গড় পাসের হার আগের বছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ কমে ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে এটি সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম নিম্ন পাসের হার।
আলিম পরীক্ষায় তুলনামূলক ভালো ফল
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত আলিম পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছেন ৪ হাজার ২৬৮ জন শিক্ষার্থী। যদিও গত বছরের তুলনায় পাসের হার কিছুটা কমেছে, তবু দেশের অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের তুলনায় মাদ্রাসা বোর্ড এবারও শীর্ষে রয়েছে।
শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, এ বছর সারাদেশে প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থী আলিম পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করেছে এক লাখ ৩৬ হাজারের বেশি। ফল প্রকাশের পর থেকেই মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখা গেছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, “শিক্ষার্থীরা আন্তরিকভাবে পড়াশোনা করেছে, আর শিক্ষক ও অভিভাবকদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখন গুণগত শিক্ষার দিকে জোর দিচ্ছি—শুধু পাসের হার নয়, নৈতিকতা ও জ্ঞানচর্চার মান উন্নয়নই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা লক্ষ্য করছি, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এটি ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক সংকেত।”
কারিগরি শিক্ষায় ধীর অগ্রগতি
অন্যদিকে, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এইচএসসি (ভোকেশনাল/বিএম/ডিপ্লোমা ইন কমার্স) পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এবার ১ হাজার ৬১০ জন শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ পেয়েছে।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. আলমগীর হোসেন বলেন, “পাসের হার কিছুটা কম হলেও শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে আমরা মনোযোগ দিচ্ছি। হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ ও ইন্ডাস্ট্রি–সংযুক্ত শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ফলাফলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
তিনি জানান, এবার অনেক প্রতিষ্ঠানেই নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী পরীক্ষা হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী প্রথমবারের মতো প্র্যাকটিক্যাল মূল্যায়নের আওতায় এসেছে, যা তাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।
জাতীয় চিত্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার সকালে একযোগে দেশের ৯টি সাধারণ, কারিগরি ও মাদ্রাসা—মোট ১১টি শিক্ষা বোর্ডে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। জাতীয়ভাবে গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন প্রশ্ন কাঠামো, মূল্যায়ন নীতির পরিবর্তন এবং অনলাইন ক্লাসে অনিয়মিত উপস্থিতি—সবকিছু মিলে এবার ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. রেহানা পারভীন বলেন, “কোভিড-পরবর্তী সময় থেকে শিক্ষার্থীরা এখনও পূর্ণ সক্ষমতায় ফিরতে পারেনি। ধারাবাহিক শিক্ষার অভাব ও মৌলিক প্রস্তুতির ঘাটতি এবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।”
শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া: আনন্দ, হতাশা ও আশা
ফল প্রকাশের পর রাজধানীর বিভিন্ন মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ আনন্দে উৎফুল্ল, কেউ আবার হতাশ।
আলিম পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পাওয়া কুমিল্লার ছাত্রী নুসরাত তাসনিম বলেন, “আমি খুব খুশি। ভবিষ্যতে ইসলামিক স্টাডিজে উচ্চশিক্ষা নিতে চাই।”
অন্যদিকে ঢাকার কারিগরি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী রাফিদ হাসান বলেন, “ফল প্রত্যাশার চেয়ে কিছুটা কম। তবে আমি ভবিষ্যতে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই।”
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ফলাফল বিশ্লেষণ করে আগামী বছর থেকে নতুন করে কারিগরি ও মাদ্রাসা খাতে মান উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, পরীক্ষার স্বচ্ছতা ও আধুনিকায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার বলেন, “যদিও সামগ্রিক ফল কিছুটা হতাশাজনক, তবু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। কারিগরি শিক্ষাকে আরও কর্মমুখী ও বাস্তবমুখী করতে হবে।”
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের ফলাফল প্রমাণ করেছে—বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন নতুন করে ভারসাম্য আনার সময় এসেছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, আর কারিগরিতে দক্ষতা ও কর্মসংস্থান—এই দুই দিকেই ভবিষ্যতের মূল ফোকাস হওয়া উচিত।










সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited