চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) এলাকায় বৃহস্পতিবার দুপুরে শুরু হওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টার প্রচেষ্টার পর শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, এখনো কিছু জায়গায় ধোঁয়া বের হচ্ছে এবং আগুন পুরোপুরি নেভাতে আরও সময় লাগবে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভবনটিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মোট ২৫টি ইউনিট। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের রোবটিক ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করা হয় আগুন নিয়ন্ত্রণে। রাতের বৃষ্টিতে আগুন নেভাতে সহায়তা মেলে। তবে ততক্ষণে ভবনটির একাধিক তলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কয়েকটি ছাদ ধসে পড়ে।
ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত ও তা ছড়িয়ে পড়া
বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ১০ মিনিটে সিইপিজেডের ‘অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড’ ও ‘জিহং মেডিক্যাল কোম্পানি’ নামের দুটি কারখানার গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। অ্যাডামস তোয়ালে ও ক্যাপ উৎপাদন করত, আর জিহং মেডিক্যাল তৈরি করত সার্জিক্যাল গাউন। উভয় প্রতিষ্ঠানের গুদাম ছিল সাততলায়, যেখানে প্রচুর দাহ্য পদার্থ মজুত ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম জানান, “ভবনটি কোড অনুযায়ী নির্মিত হয়নি। এর কাঠামোগত ত্রুটির কারণে আমাদের ফায়ার ফাইটারদের ভবনে প্রবেশে বেগ পেতে হয়েছে। পাশের ভবনটি খুব কাছেই থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল, কিন্তু আমাদের টিমের একত্র প্রচেষ্টায় বড় বিপর্যয় এড়ানো গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “ইপিজেড কর্তৃপক্ষ দ্রুত শ্রমিকদের সরিয়ে নেওয়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি—এটাই সবচেয়ে স্বস্তির বিষয়। ভবনটি বহুমুখী কাজে ব্যবহৃত হতো, নিচের তলাগুলো গুদাম হিসেবে এবং উপরতলাগুলো উৎপাদন এলাকায় ছিল।”
ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
তাজুল ইসলাম আরও জানান, “আগুনে ভবনটির কলাম ও কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই ভবনে কেউ যেন প্রবেশ না করে, সে বিষয়ে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। ইতোমধ্যে ভবনের সামনে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ লেখা ব্যানার টানানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। সার্ভে শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ভবনটি অপসারণ করা হবে কি না।”
ফায়ার সার্ভিস তাদের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যারা ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। এ ছাড়া সিইপিজেড কর্তৃপক্ষও আলাদা করে তদন্ত কমিটি করেছে, যার নেতৃত্বে থাকবেন একজন ফায়ার কনসালটেন্ট।
ইপিজেড কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা
সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুস সোবহান বলেন, “আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমরা পুরো এলাকা কর্ডন করি এবং শ্রমিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেই। এতে ইনজুরি বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই তাদের দ্রুত সহযোগিতার জন্য।”
তিনি আরও জানান, “আমাদের সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানই ফায়ার কমপ্লায়েন্সের আওতায় থাকে। এ ভবনেও কিছুদিন আগে শ্রমিকদের নিয়ে ফায়ার ড্রিল (মহড়া) করা হয়েছিল। আমরা আশা করছি, তদন্তের মাধ্যমে আগুনের প্রকৃত কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দ্রুত জানা যাবে।”
অগ্নি-নিরাপত্তায় নতুন সতর্কতা ও নির্দেশনা
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক ভবিষ্যৎ ঝুঁকি এড়াতে সব ইপিজেড ভবনে দ্রুত ফায়ার কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট নবায়ন ও বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়—এটা দেশের শিল্পখাত ও রপ্তানি অর্থনীতির জন্যও বড় ক্ষতি। সবাইকে প্রশিক্ষিত করতে হবে, প্রতিটি ভবনে ফায়ার অ্যালার্ম, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও নির্গমন পথ নিশ্চিত করতে হবে।”
ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী, ঘটনাস্থলে এখনো ১৭টি ইউনিট কাজ করছে এবং আগুনের ভেতরে থাকা ধোঁয়া ও গলিত পদার্থ পুরোপুরি অপসারণ করতে আরও সময় লাগবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা যায়নি।
দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টার টানা প্রচেষ্টা, শতাধিক ফায়ার ফাইটারের নিরলস পরিশ্রম এবং বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগে ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে বড় কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও ক্ষতির পরিমাণ যে বিপুল, তা স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শিল্প এলাকায় অগ্নি-নিরাপত্তার মান উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি—না হলে একের পর এক এ ধরনের দুর্ঘটনা জাতীয় অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
