দীর্ঘদিন ধরে বর্ষা এলেই জলজটের দুঃস্বপ্নে ভুগতেন কালীঘাট, ভবানীপুর ও চেতলার মানুষ। বৃষ্টির সঙ্গে হুগলি নদীর জোয়ারের চাপ মিললেই টালিনালা বা আদিগঙ্গার জল উপচে পড়ত রাস্তায়, কখনও কখনও ঢুকে যেত ঘরের ভিতরেও। বহু বছর ধরে নাগরিক জীবনের এই দুর্ভোগ যেন ‘নিত্য সঙ্গী’ হয়ে উঠেছিল। অবশেষে সেই চিরাচরিত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটছে কলকাতা পুরসভা।
১৩৪ কোটির প্রকল্প: দইঘাটে ব্যারাজ নির্মাণ
হুগলি নদী ও টালিনালার সংযোগস্থল দইঘাটে একটি বড় ব্যারাজ বা লকগেট তৈরি করছে কলকাতা পুরসভা। এই ব্যারাজই হবে জলনিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র। বুধবার পুরসভার সদর দপ্তরে মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন,
“দইঘাটে আমরা একটি ব্যারাজ নির্মাণ করছি। কাজ শেষ হলে কালীঘাট, ভবানীপুর ও চেতলা অঞ্চলের মানুষকে আর বানের জলে ভুগতে হবে না।”
তিনি আরও জানান, প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা, এবং কাজ সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে দুই বছর।
পুরসভা ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি সূত্র জানায়, এই ব্যারাজ নির্মাণের ফলে জলপ্রবাহের দিক ও গতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এতে হুগলি নদীর জোয়ারের সময় টালিনালা দিয়ে জল শহরের ভেতরে ঢোকা রোধ হবে। একইসঙ্গে বর্ষার সময় শহরের বৃষ্টির জল দ্রুত নিষ্কাশনও সহজ হবে।
জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে তিন ওয়ার্ডে
এই প্রকল্পের ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন ৭৩, ৮৩ ও ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। এই তিনটি ওয়ার্ড দীর্ঘদিন ধরেই জলাবদ্ধতার সমস্যায় জর্জরিত।
ঘটনাচক্রে, ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসভবন অবস্থিত। পুরসভা সূত্রে জানা গেছে, অতীতে বানের জলে একাধিকবার প্লাবিত হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িও।
৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর প্রবীর মুখোপাধ্যায় প্রায়ই পুরসভার অধিবেশনে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান চেয়ে সরব হতেন। অবশেষে পুরসভার উদ্যোগে সেই দাবি বাস্তবায়নের পথে।
মেয়রের মন্তব্য: “স্থায়ী সমাধানের পথে আমরা”
মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন,
“দশকের পর দশক ধরে কালীঘাট ও আশপাশের এলাকা জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত। আমরা চাইছিলাম এমন একটি প্রকল্প, যা স্থায়ীভাবে এই দুর্ভোগের অবসান ঘটাবে। দইঘাটে ব্যারাজ নির্মাণ হলে তা বাস্তবায়িত হবে।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“এই প্রকল্প কেবল এক-দুটি ওয়ার্ড নয়, গোটা দক্ষিণ কলকাতার জল নিষ্কাশন ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
কীভাবে কাজ করবে ব্যারাজটি?
পুরসভা সূত্রে জানা গেছে, দইঘাটে তৈরি ব্যারাজে থাকবে আধুনিক জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও স্বয়ংক্রিয় গেট। জোয়ারের সময় গেট বন্ধ থাকবে, যাতে নদীর জল শহরে প্রবেশ করতে না পারে। ভাটা নামলে গেট খুলে দেওয়া হবে, তখন শহরের বৃষ্টির জল সহজেই টালিনালা হয়ে হুগলিতে গিয়ে পড়বে।
একজন প্রকৌশলী বলেন,
“এই ব্যারাজ একদিকে জোয়ারের জল ঠেকাবে, অন্যদিকে শহরের জমে থাকা বৃষ্টির জল দ্রুত নিষ্কাশন করবে—এটাই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।”
বাসিন্দাদের স্বস্তি ও প্রত্যাশা
কালীঘাটের বাসিন্দা রোহিত দে বলেন,
“বর্ষা মানেই ছিল দুঃস্বপ্ন। ঘরে জল ঢুকত, ফ্রিজ-ফার্নিচার ভাসত। মেয়রের ঘোষণায় আমরা আশাবাদী। আশা করছি এই প্রকল্প সত্যিই আমাদের মুক্তি দেবে।”
চেতলার গৃহবধূ অর্চনা সাহা বলেন,
“বছরের পর বছর ধরে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে হতো হাঁটু সমান জল পেরিয়ে। পুরসভার এই প্রকল্প যদি সফল হয়, তাহলে সত্যিই স্বস্তি মিলবে।”
পুরসভার বৃহত্তর পরিকল্পনা
পুরসভা কর্মকর্তাদের দাবি, দইঘাট ব্যারাজ প্রকল্প দক্ষিণ কলকাতার ড্রেনেজ উন্নয়নের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। এর পাশাপাশি আদিগঙ্গার সংস্কার, ড্রেন নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণ ও পাম্পিং স্টেশনের সক্ষমতা বাড়ানোর কাজও চলছে।
একজন সিনিয়র অফিসার বলেন,
“আমরা চাই দক্ষিণ কলকাতা ধীরে ধীরে ‘জলমুক্ত অঞ্চল’ হয়ে উঠুক। দইঘাট ব্যারাজ সেই লক্ষ্যপূরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।”
কালীঘাটের ঐতিহ্য রক্ষায় বাড়তি সুবিধা
এই প্রকল্পের ফলে শুধু জলাবদ্ধতা নয়, কালীঘাট মন্দির এলাকা ও আশপাশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যও সুরক্ষিত থাকবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরের পর বছর বানের জলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কালীঘাটের পুরোনো ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
পুরসভার এই উদ্যোগে সেই ঐতিহ্যও রক্ষা পাবে বলে মনে করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল।
দুই বছরের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস
প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। মেয়র জানিয়েছেন, দুই বছরের মধ্যে ব্যারাজ নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্মাণকালীন সময়ে স্থানীয়দের অসুবিধা কমাতে বিকল্প রাস্তা ও নিকাশি ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনাও রয়েছে।
শেষ কথা
দশকের পর দশক ধরে কালীঘাট-ভবানীপুর-চেতলার মানুষের কাছে জলাবদ্ধতা ছিল এক অনিবার্য দুর্ভোগ। অবশেষে সেই ইতিহাসে টানতে চলেছে পূর্ণচ্ছেদ। যদি প্রকল্প সময়মতো শেষ হয় ও কার্যকর হয়, তবে এই তিন অঞ্চল পাবে বহু প্রতীক্ষিত স্বস্তি—জলমুক্ত, স্বস্তির এক নতুন ভোর।
