শিলিগুড়ি শহরজুড়ে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে এক নার্সিংহোমে সংঘটিত চিকিৎসা–সংক্রান্ত মারামারি ও বিশৃঙ্খলার ঘটনা। মঙ্গলবার বিকেলে প্রধাননগর থানার অন্তর্গত এক বেসরকারি নার্সিংহোমে রোগীর আত্মীয় ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমুল বাগ্বিতণ্ডা, যা পরে রীতিমতো হাতাহাতি ও ভাঙচুরে গড়ায়। এক পক্ষ অভিযোগ করেছে হেনস্থার, অন্য পক্ষ পাল্টা দাবি করেছে কর্মীদের ওপর হামলার। ঘটনাটি ঘিরে এলাকায় তৈরি হয়েছে উত্তেজনা, আর পুলিশ ইতিমধ্যেই তদন্তে নেমেছে।
চিকিৎসা থেকে সংঘর্ষে: ঘটনার শুরু
অভিযোগকারী কার্শিয়াংয়ের বাসিন্দা সুমেন্দ্র তামাং জানান, প্রায় এক মাস আগে তাঁর ভগ্নিপতি ভবেশ রাইকে ওই নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয় চিকিৎসার জন্য। তাঁদের পরিবার একটি বেসরকারি কোম্পানির স্বাস্থ্যবিমা স্কিমের আওতায় থাকায় চিকিৎসার খরচ সেই বিমা থেকেই বহন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিমা সংক্রান্ত কাগজপত্র গ্রহণে টালবাহানা করতে থাকেন—এমনটাই দাবি সুমেন্দ্রর।
তার ভাষায়,
“আমাদের সব ডকুমেন্ট ঠিকঠাক জমা দেওয়ার পরও হাসপাতাল নগদ টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। আমরা বারবার বলেছি, বিমা কোম্পানি খরচ বহন করবে। তবু কর্তৃপক্ষ বিমা এড়িয়ে গিয়ে নগদ দাবি করতে থাকে।”
সুমেন্দ্রর আরও অভিযোগ, মঙ্গলবার বিকেলে বিল পরিশোধ নিয়ে কথা বলতে গেলে নার্সিংহোমের এক ডিরেক্টর তাঁর সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন।
“আমার গায়ে হাত তোলেন, গালাগাল করেন, এমনকি আমাকে ‘ভিখারি’ বলেও অপমান করে বেরিয়ে যেতে বলেন”—অভিযোগ করেন তিনি।
এই ঘটনার পর তিনি প্রধাননগর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
পাল্টা অভিযোগ নার্সিংহোমের
অন্যদিকে, ওই রাতেই নার্সিংহোমের পক্ষ থেকেও পাল্টা অভিযোগ দায়ের করা হয়। প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর মনোহরলাল ধনধনিয়া থানায় দেওয়া লিখিত অভিযোগে জানান, রোগীর পরিবারের আচরণ ছিল “অতি উত্তেজনাপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক”।
ধনধনিয়ার দাবি,
“রোগীর মোট বিল হয়েছে ৬ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। বিমা কোম্পানি এখন পর্যন্ত মাত্র ২ লক্ষ টাকা অনুমোদন করেছে। আমরা রোগীর পরিবারের কাছে বকেয়া টাকার বিষয়ে জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা এসে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, আলোচনার সময় সুমেন্দ্র ও তাঁর সঙ্গীরা হাসপাতালের এক কক্ষ ভাঙচুর করেন এবং মহিলা রিসেপশনিস্টের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন।
“পরিস্থিতি সামলাতে গেলে আমাদের কর্মীদের ওপরও চড়াও হন তাঁরা,” বলেন ধনধনিয়া।
তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করা হলেও মনোহরলাল ধনধনিয়া সাড়া দেননি।
পুলিশি তদন্ত শুরু
প্রধাননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাসুদেব সরকার জানিয়েছেন,
“দু’পক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে পৃথক মামলা রুজু করা হয়েছে। ঘটনাটি তদন্তাধীন।”
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নার্সিংহোমের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে প্রকৃত ঘটনাপ্রবাহ বোঝা যায়। একইসঙ্গে উভয়পক্ষের বক্তব্য রেকর্ড করা হবে এবং সাক্ষীদের জবানবন্দিও নেওয়া হবে।
পুলিশ বলছে, এখনই কেউ আটক হননি, তবে পরিস্থিতি যাতে উত্তপ্ত না হয় সেজন্য হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্ন
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর শহরের চিকিৎসাপ্রেমী মহল থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকরাও প্রশ্ন তুলেছেন—চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও রোগীর পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক কেন এতটা টানাপোড়েনের পর্যায়ে যাচ্ছে?
শিলিগুড়ির সমাজকর্মী অরিন্দম ঘোষ বলেন,
“বিমা সংক্রান্ত জটিলতা এখন প্রায় প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার জন্য এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়া উদ্বেগজনক।”
তিনি আরও বলেন, “রোগীর পরিবার যদি বিমার আওতায় থাকে, হাসপাতালগুলোকেও উচিত সেই প্রক্রিয়া সম্মানের সঙ্গে অনুসরণ করা। অন্যদিকে, আত্মীয়দেরও ধৈর্য রাখতে হবে।”
চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিশ্বাসের প্রশ্ন
এই ঘটনা নতুন করে সামনে এনেছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও বিমা-প্রক্রিয়ার জটিলতা নিয়ে চলমান বিতর্ক। অনেক সময় দেখা যায়, বিমা কোম্পানির অনুমোদন বিলম্বিত হওয়ায় রোগীর পরিবারের ওপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়, আর সেই চাপ থেকেই জন্ম নেয় এমন বিরোধ।
শিলিগুড়ির এই ঘটনাও হয়তো সেই ব্যবস্থাগত ব্যর্থতারই প্রতিফলন।
বর্তমানে রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানা গেছে। তবে হাসপাতাল প্রশাসন ও রোগীর পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক এতটা খারাপ হওয়ায় প্রশ্ন উঠছে—চিকিৎসা কি এখন বাণিজ্যে পরিণত হচ্ছে, নাকি বিশ্বাসের সংকটটাই দিনকে দিন গভীর হচ্ছে?
যেভাবেই হোক, পুলিশি তদন্তের পরেই স্পষ্ট হবে—আসলে কে দোষী আর কে নির্দোষ। কিন্তু এ ঘটনায় যে মানুষের আস্থায় নতুন করে ফাটল ধরেছে, তা আর অস্বীকার করা যায় না।


সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited