কালীপুজো ও দীপাবলিকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গজুড়ে শুরু হয়েছে বাজি বিক্রির জোর প্রস্তুতি। কিন্তু নিষিদ্ধ শব্দবাজির রমরমা ঠেকাতে এবারও সক্রিয় হয়েছে পুলিশ প্রশাসন। এরই অংশ হিসেবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় গত কয়েক দিনে টানা অভিযান চালিয়ে পুলিশ বিপুল পরিমাণ শব্দবাজি ও বাজি তৈরির উপকরণ উদ্ধার করেছে। আটক করা হয়েছে অন্তত চারজনকে।
গত দু’দিনে মহিষাদল ও তমলুক থানার পুলিশ আলাদা অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩৬৫ কেজি নিষিদ্ধ বাজি ও কাঁচামাল বাজেয়াপ্ত করেছে। পাশাপাশি, গত সপ্তাহে এগরা থানার অভিযানে আরও প্রায় ৭ লক্ষ টাকার বাজি উদ্ধার হয়। ফলে মোট বাজেয়াপ্ত বাজির পরিমাণ প্রায় অর্ধ টনের কাছাকাছি।
মহিষাদলে বাজেয়াপ্ত ২১৫ কেজি শব্দবাজি
সোমবার রাতে মহিষাদল থানা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। স্থানীয় চিঙ্গুরমারি গ্রামের বাসিন্দা কমল মাজির বাড়ি থেকে প্রায় ২১৫ কেজি নিষিদ্ধ শব্দবাজি ও বাজি তৈরির উপকরণ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কমল দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বাজি তৈরি করতেন এবং স্থানীয়ভাবে তা বিক্রি করতেন।
মহিষাদল থানার এক কর্মকর্তা জানান, “প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি ওডিশা থেকে কাঁচামাল এনে স্থানীয় বাজারে বাজি বিক্রি করতেন। মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে।” মঙ্গলবার কমল মাজিকে হলদিয়া মহকুমা আদালতে তোলা হয়।
তমলুকে দোকানের আড়ালে বাজির কারবার
তার একদিন আগে, রবিবার রাতে তমলুক থানার পুলিশ শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকের ডিমারি বাজারে হানা দেয়। সেখানে স্থানীয় দোকানদার তপন চক্রবর্তীর দশকর্মার দোকান থেকে প্রায় ১৫০ কেজি নিষিদ্ধ শব্দবাজি উদ্ধার করা হয়।
তপনের দোকানটি সাধারণত পূজোর সময় ধর্মীয় সামগ্রী বিক্রির জন্য পরিচিত হলেও, পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এর আড়ালেই চলছিল অবৈধ বাজি ব্যবসা। দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে গোপনে শব্দবাজি মজুত রাখা এবং বিক্রি হচ্ছিল বলে অভিযোগ।
থমলুক থানার এক কর্মকর্তা জানান, “গোপন সূত্রে খবর পেয়ে আমরা অভিযান চালাই। দোকানটি থেকে যেভাবে বিপুল পরিমাণ বাজি উদ্ধার হয়েছে, তাতে আরও কেউ এই চক্রে যুক্ত থাকতে পারে।”
সোমবার আদালতে তপনকে তোলা হলে বিচারক তাকে ১৪ দিনের জেল হেফাজতে পাঠান। পুলিশ এখন খতিয়ে দেখছে, এই বাজি ব্যবসার সঙ্গে জেলার অন্য কোনও পাইকারি সরবরাহ চক্র যুক্ত কি না।
ওডিশা সংযোগে এগরার অভিযান
এর আগেই গত বুধবার এগরা থানার পুলিশ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ওডিশা থেকে আসা একটি ইঞ্জিনভ্যান আটক করে। ভ্যানটিতে করে প্রায় ৭ লক্ষ টাকার নিষিদ্ধ বাজি পূর্ব মেদিনীপুরে আনা হচ্ছিল।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বাজিগুলো এগরা ২ নম্বর ব্লকের বেতার এলাকায় নামানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পুলিশের আগাম তৎপরতায় দু’জন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিপুল পরিমাণ বাজি বাজেয়াপ্ত হয়।
পুলিশের সতর্কতা ও প্রশাসনের বার্তা
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশ জানিয়েছে, কালীপুজোকে সামনে রেখে প্রতিটি থানায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। বাজি তৈরির কারখানা, পাইকারি গুদাম ও বাজার এলাকায় গোপন নজরদারি চালানো হচ্ছে।
জেলার এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, “বিধি অনুযায়ী ৯০ ডেসিবেল এর বেশি শব্দ উৎপন্ন করে এমন বাজি নিষিদ্ধ। আমরা চাই এই উৎসব নিরাপদে, দুর্ঘটনামুক্তভাবে কাটুক। তাই যেখানেই অবৈধ বাজির হদিস মিলবে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বাজি ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছে যে, অনুমোদিত লাইসেন্স ছাড়া বাজি বিক্রি বা মজুত রাখলে বিস্ফোরক আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয়দের উদ্বেগ
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রতি বছর কালীপুজোর আগে এমন বাজি তৈরির খবর সামনে আসে, কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর পরিস্থিতি আবার আগের মতো হয়ে যায়।
মহিষাদলের শিক্ষক অজয় ঘোষ বলেন, “গ্রামে অনেকেই জানে কারা বাজি বানায়, কিন্তু ভয় বা স্বার্থের কারণে কেউ মুখ খোলে না। পুলিশ এবার কঠোর ব্যবস্থা নিলে হয়তো এই প্রবণতা কিছুটা কমবে।”
কালীপুজো ও দীপাবলির আনন্দ যেন শব্দদূষণ বা দুর্ঘটনায় ম্লান না হয়—এই বার্তাই দিচ্ছে প্রশাসন। পূর্ব মেদিনীপুরের এই অভিযান তাই শুধু নিষিদ্ধ বাজির বিরুদ্ধে নয়, উৎসবকে নিরাপদ রাখারও উদ্যোগ।
