হুগলির তারকেশ্বরের অদূরে সৈতা গ্রাম। প্রায় শত বছর আগে এখানকার কয়েকজন বালকের হাতে খেলার ছলেই শুরু হয়েছিল এক অনন্য কালীপুজোর যাত্রা। এখন সেই পুজোই পরিণত হয়েছে গ্রামের ঐতিহ্য ও সামাজিক মিলনের অন্যতম প্রতীক হিসেবে। স্থানীয়ভাবে এই পূজোটি পরিচিত ‘ছেলে কালী’ পুজো নামে—যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ স্মৃতি, বিশ্বাস, এবং প্রজন্মান্তরের আস্থা।
খেলার ছলে জন্ম ঐতিহ্যের
প্রায় ১০০ বছর আগে, কয়েকজন বালক—পশুপতি রায়, শম্ভু রায়, নির্মল আশ, রঘুপতি দাস ও সুধা দাস—তালপাতার ঘর বানিয়ে খেলার ছলে তৈরি করেছিল একটি ছোট্ট কালীমূর্তি। মূর্তি যখন হয়েছে, তখন পূজোও করতেই হবে—এই ভাবনা থেকেই শুরু হয় পূজার আয়োজন।
সেই ছোট্ট আয়োজনই পরবর্তীকালে রূপ নেয় বৃহৎ সামাজিক উৎসবে। এখন সৈতা গ্রামের এই পূজো চলে বিশাল মন্দিরে, আলো, বাদ্য, হরির লুঠ আর ভক্তদের উপচে পড়া ভিড়ে।
আগুন, অলৌকিকতা ও ‘জাগ্রত মা’-র কাহিনি
গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দাদের মতে, প্রথম দিকের পূজায় একবার অন্য এক দলের কালীমূর্তিতে আগুন ধরে যায়। তখন থেকেই গ্রামে রটে যায়, ‘ছেলে কালী’ মা ভীষণ জাগ্রত দেবী। সেই থেকেই এই নামটি স্থায়ী হয়ে যায়।
যাঁরা এই পূজো শুরু করেছিলেন, তাঁরা আর কেউ জীবিত নেই, কিন্তু তাঁদের উত্তরসূরিরা আজও গর্বের সঙ্গে পূজার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। সময়ের সঙ্গে বদলেছে কেবল আয়োজনের পরিধি—শ্রদ্ধা, বিশ্বাস আর আবেগের গভীরতা আজও একই রকম অটুট।
প্রতিমা তৈরির ঐতিহ্য ও আচার
প্রতিমাটি তৈরি হয় হুগলিরই মির্জাপুরে এক ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পীর হাতে। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর পরদিন কাঠামো দিয়ে আসা হয়, তারপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে দেবীমূর্তি।
পুজোর আগের রাতে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গ্রামবাসীরা শোভাযাত্রা করে দেবীকে বেদীতে আনেন। দেবী আসার পথে হরির লুঠ হয়—বাতাসা বিলিয়ে মানুষ আনন্দে মেতে ওঠেন। একসময় তালপাতার ছাউনিতে হতো এই পূজো, এখন গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে এক বিশাল পাকা মন্দির।
প্রজন্মের হাত ধরে ঐতিহ্যের সংরক্ষণ
নির্মল আশের বড় ছেলে উত্তম আশ আবেগঘন কণ্ঠে বলেন,
“খুব ছোটবেলায় আমার বাবা ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু এই পূজো শুরু করেছিলেন। মা খুব জাগ্রত। আমি একবার মায়ের মন্দির করার কথা বলেছিলাম, কিন্তু তখন সেটা সম্ভব হয়নি। পরে মা স্বপ্নে এসে মন্দির করার নির্দেশ দেন। এরপরই আমরা মন্দিরটি নির্মাণ করি।”
তাঁর এই বক্তব্যে যেন প্রতিফলিত হয় এক শতবর্ষের বিশ্বাসের ধারাবাহিকতা—যে বিশ্বাস আজও সৈতা গ্রামবাসীর হৃদয়ে অবিচল।
বিশ্বাস, ভক্তি ও মিলনের উৎসব
কালীপুজোর রাতে সৈতা গ্রামের মন্দির চত্বর ভরে ওঠে ভক্তে, আলোয়, ঢাকের তালে আর ভক্তিমন্ত্রের সুরে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, এই দেবী তাঁদের সকল সংকটের সময় রক্ষা করেন, মায়ের নাম উচ্চারণে দূর হয় দুঃখ-কষ্ট।
