জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের পরিবারের সদস্য ও আহত জুলাই যোদ্ধাদের সম্মানে এক আবেগঘন মতবিনিময় সভা ও সংবর্ধনার আয়োজন করেছে নেত্রকোণা জেলা প্রশাসন।
সোমবার (তারিখ) দুপুরে জেলা শহরের মোক্তারপাড়ায় অবস্থিত পাবলিক হল মিলনায়তনে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিভিল সার্জন ডা. গোলাম মওলা, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ও নেত্রকোণা পৌরসভার প্রশাসক আরিফুল ইসলাম সরদার, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মোহা. কামরুল হুদা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুখময় সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সজল কুমার সরকার, জেলা প্রেসক্লাবের সম্পাদক মাহবুবুল কিবরিয়া চৌধুরী হেলিম, শহিদ ও আহত সেলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী নূর মোহাম্মদ আয়েশ, ওয়ারিয়র্স অব জুলাইয়ের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ এবং শহিদ ও আহত যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য রাজিব মিয়া প্রমুখ।
শহিদদের স্মরণে একাত্মতা ও আবেগের পরিবেশ
সভা শুরুতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সকল শহিদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত ও গীতা পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। মিলনায়তনে তখন এক গভীর শ্রদ্ধা ও আবেগের আবহ বিরাজ করছিল।
পরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের সম্মানে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রমের স্থিরচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সভায় বক্তব্য রাখেন দুর্গাপুরের শহিদ ওমর ফারুকের মা কুলসুম আক্তার। আবেগঘন কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আজ তার কথা মনে পড়লে বুকটা ভরে ওঠে গর্বে, কিন্তু একই সঙ্গে কষ্টও হয়—তার স্বপ্নগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।” তার এই বক্তব্যে উপস্থিত অনেকেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।
প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগ
সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান শহিদ পরিবারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিনাশী অধ্যায়। তাদের ত্যাগের স্মৃতি সংরক্ষণ আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”
তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহিদ পরিবারের সদস্য ও আহত জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন—
“জেলায় শহিদ সতেরোটি পরিবারকে বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল স্থাপন করা হবে। পর্যায়ক্রমে আহত জুলাই যোদ্ধাদেরও একই সুবিধা দেওয়া হবে। পাশাপাশি শহিদদের কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, প্রতিটি উপজেলায় জুলাই স্মৃতি সংরক্ষণে একটি করে ‘জুলাই স্মৃতি ক্লাব’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস জানবে এবং গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করবে।
সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান
আলোচনা সভা শেষে শহিদ পরিবারের সদস্যদের হাতে স্মারক সম্মাননা তুলে দেন জেলা প্রশাসক। এছাড়া উপস্থিত প্রত্যেক আহত জুলাই যোদ্ধাকে সম্মানসূচক উপহার, যাতায়াত খরচ এবং উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়।
অনুষ্ঠানে জেলার ১৭ শহিদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও বহু আহত জুলাই যোদ্ধা অংশ নেন। মিলনায়তনে তখন একাত্মতা, শ্রদ্ধা ও গর্বের এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
ইতিহাস সংরক্ষণে নতুন অঙ্গীকার
সভায় বক্তারা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল বঞ্চনা ও দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রতীক। শহিদদের আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস।
শহিদ ও আহত সেলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী নূর মোহাম্মদ আয়েশ বলেন, “শহিদদের রক্ত বৃথা যায়নি। তাদের আত্মত্যাগের ফসলই আজকের গণতন্ত্র, আজকের বাংলাদেশের মানুষ।”
ওয়ারিয়র্স অব জুলাইয়ের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ বলেন, “আমরা চাই, এই ইতিহাস বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না থেকে মানুষের চেতনায় বেঁচে থাকুক।”
অনুষ্ঠানের শেষে জেলা প্রশাসক উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “আমরা যদি শহিদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করি, তবেই তাদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রক্ষা হবে।”
শেষ কথায়
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আয়োজিত এই সভা নেত্রকোণায় এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। শহিদ পরিবারের চোখে অশ্রু ছিল, তবে সেই অশ্রুতে ছিল গর্বের দীপ্তি—বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার অটল অঙ্গীকার।
