আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত আবারও রক্তাক্ত সংঘর্ষে কেঁপে উঠেছে। আফগান তালেবান সরকারের দাবি, শনিবার রাত থেকে রোববার ভোর পর্যন্ত চলা তীব্র গোলাগুলিতে ৫৮ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে। পাল্টা হামলায় তালেবানের ৯ জন সেনা প্রাণ হারিয়েছে বলেও কাবুল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে।
রোববার সকালে রাজধানী কাবুলে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তালেবান সরকারের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, “রাতভর চলা এই সংঘর্ষে পাকিস্তানের সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে আফগান ভূখণ্ডে গোলাবর্ষণ করেছিল। আমাদের প্রতিরক্ষাবাহিনী পাল্টা জবাব দিতে বাধ্য হয়। এতে পাকিস্তানের ৫৮ সেনা নিহত ও বহু আহত হয়েছে।”
এই ঘটনার বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ইসলামাবাদের সামরিক সূত্রগুলো বলছে, আফগান সীমান্তবর্তী চমন ও স্পিন বোলদাক এলাকায় হঠাৎ ভারী গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পটভূমি: দীর্ঘদিনের উত্তেজনা
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্ত, যা ডুরান্ড লাইন নামে পরিচিত, বহু বছর ধরেই উত্তেজনার উৎস। তালেবান সরকার ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে গুলি বিনিময়, বিমান হামলা এবং সশস্ত্র অনুপ্রবেশের অভিযোগ প্রায় নিয়মিত।
বিশেষত, পাকিস্তান অভিযোগ করে আসছে— আফগান ভূখণ্ডে সক্রিয় তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) জঙ্গিরা পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে আবার আফগানিস্তানে পালিয়ে যায়। অপরদিকে তালেবান সরকার দাবি করে, পাকিস্তান সীমান্তে বারবার উসকানিমূলক হামলা চালিয়ে পরিস্থিতি জটিল করছে।
গত দুই মাসেই সীমান্তের দুই প্রান্তে চার দফা সংঘর্ষ হয়েছে, যাতে উভয় পক্ষের প্রায় ১০০ জনের বেশি হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘের উদ্বেগ
রবিবার বিকেলে জাতিসংঘের আফগানিস্তান মিশন (ইউএএনএএমএ) এক বিবৃতিতে এই নতুন সংঘর্ষে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে সংযম প্রদর্শন করতে হবে। সীমান্তে বেসামরিক লোকদের সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতা এখন অত্যন্ত জরুরি।”
জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা আরও বলেন, উভয় দেশ যদি দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনে, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে।
বেসামরিকদের আতঙ্ক
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সংঘর্ষের সময় সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি গ্রামে গোলাবর্ষণ হয়। ফলে শতাধিক পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়েছে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের চমন শহরে অন্তত ১২ জন বেসামরিক আহত হয়েছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়।
এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “রাত থেকে সকাল পর্যন্ত গুলির শব্দ শোনা গেছে। আমরা ভয়ে সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”
বিশ্লেষকদের মত
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি হামলা বেড়ে যাওয়ায় ইসলামাবাদ এখন আফগান সীমান্তে শক্ত অবস্থান নিতে চায়। অন্যদিকে তালেবান সরকারও তাদের সার্বভৌমত্ব দেখাতে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।
কাবুলভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামিদ সাফি বলেন, “উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সীমান্ত বিরোধ এতটাই গভীর যে, সামান্য উসকানিতেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে দুই দেশের সম্পর্ক বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে।”
পরিস্থিতি এখনো উত্তেজনাপূর্ণ
রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করেছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে আফগান তালেবানও সীমান্ত এলাকায় প্রতিরক্ষাবলয় জোরদার করেছে।
আন্তর্জাতিক মহল দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানালেও, এখনো পর্যন্ত কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ দেখা যায়নি।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited