উত্তরবঙ্গের দিনহাটার উপকণ্ঠে বিশাল পাঁচ একর জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে এক অপূর্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খেলার মাঠ, কম্পিউটার ল্যাব, ক্যান্টিন, আধুনিক ক্লাসরুম, অফিস কক্ষ—সবই আছে। নেই শুধু ছাত্রীরা। এক সময় উত্তরবঙ্গের মেয়েদের শারীরিক শিক্ষার একমাত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই কলেজটি এখন যেন ভূতুড়ে প্রাসাদে পরিণত হয়েছে।
গত পাঁচ বছর ধরে বন্ধ দিনহাটার সরকারি মহিলা শারীরশিক্ষা কলেজে আজ আর ক্লাস হয় না, মাঠে ভেসে বেড়ায় আগাছা, আর নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার আধুনিক সরঞ্জাম। অধ্যক্ষ আছেন, শিক্ষকও ছয়জন রয়েছেন—তবু পঠনপাঠন বন্ধ। কারণ, নেই ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশনের (এনসিটিই) অনুমোদন।
উত্তরবঙ্গের একমাত্র মহিলা সরকারি কলেজ, অথচ তালা ঝুলছে শ্রেণিকক্ষে
১৯৮৫ সালে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী কমল গুহর উদ্যোগে শুরু হয়েছিল এই কলেজের যাত্রা। প্রথমে দিনহাটা গার্লস হাইস্কুলের চারটি ক্লাসরুমে ক্লাস শুরু হলেও পরবর্তীতে পুঁটিমারি ও বড় নাচিনা মৌজায় ৫.৪৮ একর জমিতে গড়ে ওঠে নিজস্ব ক্যাম্পাস। উত্তরবঙ্গের পিছিয়ে পড়া এলাকার মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে প্রতিষ্ঠানটি একসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
কিন্তু ২০২০ সালে এনসিটিই স্বীকৃতি বাতিল করে দেওয়ার পর থেকে সব কিছু থমকে যায়। সেই সময় কলেজে মাত্র চারজন স্থায়ী শিক্ষক থাকায় ছাত্রীর অনুপাতে শিক্ষকসংখ্যা কম ছিল—এই কারণেই বন্ধ হয়ে যায় অনুমোদন। পরবর্তী সময়ে আরও দুইজন স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, পাশাপাশি পাঁচজন পার্শ্বশিক্ষকও ছিলেন। তবু এনসিটিই–র নির্ধারিত ১৪ জন শিক্ষকের মানদণ্ডে পৌঁছানো যায়নি।
বারবার চেষ্টা করেও জট খুলছে না
২০২৩ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বাদশা ঘোষ কলেজটি পুনরায় চালুর জন্য একাধিকবার উচ্চশিক্ষা দপ্তরের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁর কথায়,
“ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে নিয়োগের জন্য পাঠানো প্যানেলটি যদি দপ্তর অনুমোদন করে, তাহলে আমরা তা এনসিটিই–র কাছে পাঠাতে পারব। তারা স্বীকৃতি দিলেই ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব।”
দু’বার শিক্ষক নিয়োগের ইন্টারভিউ নেওয়া হলেও, দপ্তরের অনুমোদনের অভাবে প্রক্রিয়া আটকে আছে। প্রথমবারের প্যানেল বাতিল হওয়ার পর গত ২৮ অগস্ট ফের নতুন করে যোগা ইনস্ট্রাকটর, ডায়েটিশিয়ান, ট্রেনার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে আটজন পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। কিন্তু সেটিও এখনো দপ্তরের টেবিলে পড়ে আছে।
সরঞ্জাম নষ্ট, ভবন ধ্বংসের পথে
পাঁচ বছর ধরে বন্ধ থাকার কারণে কলেজের মূল্যবান ল্যাব যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, খেলার সরঞ্জাম ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ছে। খেলার মাঠে ঘাস আর আগাছায় ঢেকে গেছে, ক্লাসরুমে ধুলো জমে গেছে, আর খালি করিডরে ভেসে বেড়ায় নীরবতা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কোটি টাকার সরকারি সম্পদ এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া এক প্রকার প্রশাসনিক ব্যর্থতা। একজন প্রাক্তন ছাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“এই কলেজটি আমাদের জীবনের দিশা দেখিয়েছিল। এখন সেটি ধ্বংস হতে দেখে খুব কষ্ট লাগে।”
সরকারি প্রতিশ্রুতি ও আশার আলো
তবে আশার কথা শুনিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ। তিনি জানিয়েছেন,
“দিনহাটার সরকারি মহিলা শারীরশিক্ষা কলেজটি পুনরায় চালুর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অনুমোদন প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ পর্যায়ে।”
অধ্যক্ষ বাদশা ঘোষও আশাবাদী, যদি সব অনুমোদন দ্রুত মেলে, তাহলে শুধু বিপিএড নয়, ভবিষ্যতে এমপিএড কোর্সও চালু করা সম্ভব হবে।
উত্তরবঙ্গের মেয়েদের শিক্ষার আলো আবার জ্বলবে কি?
দীর্ঘদিন ধরে উত্তরবঙ্গের মেয়েদের শারীরিক শিক্ষার একমাত্র সরকারি কেন্দ্র হিসেবে এই কলেজ ছিল এক প্রতীকের নাম। কিন্তু প্রশাসনিক গাফিলতি, অনুমোদন জট ও শিক্ষকসংকটে আজ সেটি প্রায় মৃতপ্রায়।
স্থানীয় মানুষের আশা—যেভাবে কমল গুহ একসময় এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করে মেয়েদের স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তেমনি সরকার যেন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে কলেজের প্রাণ ফিরিয়ে দেয়। কারণ, এই প্রতিষ্ঠান শুধু একটি কলেজ নয়, এটি উত্তরবঙ্গের নারীদের আত্মমর্যাদা ও সম্ভাবনার প্রতীক।
