বঙ্গোপসাগরে ভাসতে থাকা একটি মাছধরার ট্রলারসহ ২৬ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। ইঞ্জিন বিকল হয়ে তিন দিন ধরে সাগরে আটকে থাকা অসহায় জেলেদের উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে নৌবাহিনীর জাহাজ ‘বানৌজা শহীদ মহিবুল্লাহ’।
আজ বুধবার (৮ অক্টোবর) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মঙ্গলবার নিয়মিত টহল চলাকালে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান অবস্থায় ট্রলারটি চিহ্নিত করে নৌবাহিনীর সদস্যরা। পরে দ্রুত অভিযান চালিয়ে ২৬ জেলেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়।
ইঞ্জিন বিকল হয়ে মাঝসমুদ্রে আটকে পড়া
জেলেদের ভাষ্যমতে, ‘এমভি তাজমিনুর রহমান’ নামের মাছধরার ট্রলারটি গত ৩০ সেপ্টেম্বর মহেশখালী থেকে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে বঙ্গোপসাগরে যায়। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ৩ অক্টোবর তারা তীরে ফেরার কথা থাকলেও, ফেরার পথে ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। ফলে জেলেরা দিকনির্দেশনা হারিয়ে ফেলে এবং টানা তিন দিন ধরে ট্রলারটি মাঝসমুদ্রে ভেসে থাকে।
কক্সবাজার বাতিঘর থেকে প্রায় ২৭ নটিক্যাল মাইল দূরে ট্রলারটির অবস্থান শনাক্ত করা হয়। নৌবাহিনীর টহল জাহাজ ‘বানৌজা শহীদ মহিবুল্লাহ’ যখন এলাকাটি অতিক্রম করছিল, তখন তারা বিপদসংকেত দেখতে পায়। সংকেত পেয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে নৌসদস্যরা ট্রলার ও জেলেদের উদ্ধার করে।
খাবার, পানি ও চিকিৎসা সহায়তা
উদ্ধারকৃত জেলেদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। টানা কয়েক দিন সমুদ্রে ভাসতে থাকায় তাদের খাবার ও পানির মজুত শেষ হয়ে গিয়েছিল। উদ্ধারকাজ শেষে নৌবাহিনীর সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন।
নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, উদ্ধারকৃত জেলেদের নিরাপদে তীরে এনে তাদের পরিবারের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় অনাহারে ও আতঙ্কে থাকা জেলেরা বেঁচে ফিরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন নৌবাহিনীর প্রতি।
মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের অংশ হিসেবে টহল
আইএসপিআর জানিয়েছে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও উপকূলীয় জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি বর্তমানে ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান’-এর অংশ হিসেবে নৌবাহিনী নিয়মিত সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় টহল কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই টহলের মাধ্যমেই বিপদগ্রস্ত ট্রলারটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ নৌবাহিনী শুধু দেশের সমুদ্রসীমা সুরক্ষায় নয়, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তায়ও প্রতিনিয়ত কাজ করছে। ভবিষ্যতেও এই মানবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।”
‘প্রাণ বাঁচানো ছাড়া আর কোনো আশা ছিল না’
উদ্ধার হওয়া এক জেলে বলেন, “তিন দিন ধরে আমরা সমুদ্রে ভাসছিলাম। ঢেউ এত বড় হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল এখনই ডুবে যাব। খাবার-পানি কিছুই ছিল না। আমরা শুধু বেঁচে থাকার প্রার্থনা করছিলাম। হঠাৎ দূরে নৌবাহিনীর জাহাজ দেখে আমরা কাপড় নাড়িয়ে সংকেত দিই। তারা না এলে হয়তো কেউই বাঁচতাম না।”
আরেকজন বলেন, “নৌবাহিনীর লোকেরা আমাদের তুলে নেওয়ার পর পানি ও খাবার দেয়। মনে হচ্ছিল আমরা আবার নতুন জীবন পেলাম।”
উপকূলে স্বস্তির নিঃশ্বাস
উদ্ধারের খবর পেয়ে মহেশখালীর উপকূলজুড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন জেলেদের পরিবার। দিনরাত সমুদ্রে অপেক্ষায় থাকা স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়লেও জীবিত ফিরে আসায় এখন আনন্দে উদ্বেল তারা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, “নৌবাহিনীর তৎপরতা না থাকলে এই জেলেদের আর বাঁচানো যেত না। নিয়মিত টহলই আজ ২৬টি জীবন বাঁচিয়েছে।”
মানবিকতার প্রতীক নৌবাহিনী
বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রায়ই এ ধরনের উদ্ধার ও মানবিক তৎপরতায় অংশ নিচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় বা দুর্ঘটনায় আটকে পড়া জেলে ও উপকূলবাসীর পাশে দাঁড়ানো এখন তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, “দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষা, অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ, জেলেদের নিরাপত্তা ও সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণে নৌবাহিনী সর্বদা প্রস্তুত। নাগরিকদের জীবন রক্ষার এই অভিযান আমাদের দায়িত্ব ও গর্বের প্রতীক।”
