রিয়াজ গার্মেন্টস: যেখান থেকে শুরু বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের গল্প

রিয়াজ গার্মেন্টস নামটি হয়তো আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছেই অপরিচিত। কিন্তু এই একটি নাম, একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির এক মহাকাব্য। আজকের যে “মেইড ইন বাংলাদেশ” ট্যাগ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত, যার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ, সেই পথের গোড়াপত্তন করেছিল এই রিয়াজ গার্মেন্টস। এটি শুধু একটি পোশাক কারখানার নাম নয়, এটি একটি বিপ্লবের নাম, যা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। চলুন ফিরে তাকাই সেই সময়ে, যখন একটি ছোট দর্জির দোকান থেকে বিশ্ববাজারে পা রাখার এক দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু হয়েছিল।
একটি স্বপ্নের সূচনা: রিয়াজ স্টোর থেকে রিয়াজ গার্মেন্টস
সময়টা ১৯৬০ সাল। পুরান ঢাকার উর্দু রোডে “রিয়াজ স্টোর” নামে একটি দর্জির দোকানের যাত্রা শুরু হয়, যার কর্ণধার ছিলেন মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন। তখন তার প্রতিষ্ঠান মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্যই শার্ট, লেগিংসসহ বিভিন্ন পোশাক তৈরি করত। অত্যন্ত উন্নত মানের কাপড় এবং নিঁখুত সেলাইয়ের কারণে খুব অল্প সময়েই “রিয়াজ শার্ট” দেশজুড়ে একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোরের মতো বড় শহরগুলোতেও তাদের ডিলার ছিল।
কিন্তু রিয়াজউদ্দিনের স্বপ্ন ছিল আরও বড়। ১৯৬৫ সালে করাচি ভ্রমণের সময় তিনি দেখেন, সেখানকার একটি কারখানা বিদেশে লাখ লাখ পিস পোশাক রপ্তানি করছে। সেই দৃশ্যই তার মনে বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের বীজ বপন করে দেয়। তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, একদিন তার কারখানায় তৈরি পোশাকও বিদেশের বাজারে যাবে।
সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তিনি তার “রিয়াজ স্টোর”-এর নাম পরিবর্তন করে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি হিসেবে নিবন্ধিত করেন “রিয়াজ গার্মেন্টস লিমিটেড”।
ঐতিহাসিক সেই দিন: প্রথম রপ্তানির অবিশ্বাস্য মুহূর্ত
স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথটা সহজ ছিল না। দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রচেষ্টা, শ্রম ও অধ্যবসায়ের পর অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে। ১৯৭৮ সাল, বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য এক অবিস্মরণীয় বছর। ফরাসি ক্রেতা ‘হলান্ডার ফ্রঁস’-এর কাছ থেকে ১০,০০০ পিস শার্ট তৈরির অর্ডার পায় রিয়াজ গার্মেন্টস।
সেদিন কোনো কন্টেইনার ছিল না, ছিল না আধুনিক কোনো পরিবহন ব্যবস্থা। সাধারণ ট্রাকে করে সেই শার্টের চালান চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। এটিই ছিল বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পোশাক রপ্তানির প্রথম চালান, যার মোট মূল্য ছিল ১৩ মিলিয়ন ফরাসি ফ্রাঁ। এই একটি চালান শুধু কিছু শার্ট ছিল না; এটি ছিল বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের আগমনের বার্তা। এই ঘটনাই দেশের পোশাক শিল্পে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দেয় এবং অন্যদের জন্য সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার খুলে দেয়।
শুধু রপ্তানি নয়, দেশের ফ্যাশনেও ছিল অগ্রণী
বিদেশে রপ্তানির পাশাপাশি দেশের বাজারেও রিয়াজ গার্মেন্টস ছিল এক অপ্রতিরোধ্য নাম। সত্তরের দশকে তাদের শকুন্তলা, আম্রপালি এবং প্যান্ডোরা নামের তিনটি বক্ষ বন্ধনীর বিজ্ঞাপন তখনকার সময়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ক্যালেন্ডার সংযুক্ত করার মতো অভিনব কৌশলও ব্যবহার করত। এমনকি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা রাজ্জাকও তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করেছেন।
একটি বিপ্লবের ঢেউ: রিয়াজ গার্মেন্টসের দেখানো পথে
রিয়াজ গার্মেন্টসের এই সাফল্য অন্য উদ্যোক্তাদেরও অনুপ্রাণিত করে। ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়্যু করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম শতভাগ রপ্তানিমুখী কারখানা “দেশ গার্মেন্টস”। এর কর্ণধার ছিলেন নূরুল কাদের খান। তিনি ১৩০ জন কর্মীকে প্রশিক্ষণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠান, যারা ফিরে এসে দেশের পোশাক শিল্পের দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করেন।
এরপর একে একে জুয়েল গার্মেন্টস, প্যারিস গার্মেন্টসসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এই পথে যাত্রা শুরু করে। আশির দশকে এই শিল্প এক লাফে বহুদূর এগিয়ে যায় এবং কারখানার সংখ্যা ৪৭ থেকে ৫৮৭-তে পৌঁছায়। রিয়াজ গার্মেন্টস-এর জ্বালানো সেই ছোট্ট মশালটিই ধীরে ধীরে পুরো বাংলাদেশকে আলোকিত করে তোলে।
উপসংহার: এক কিংবদন্তির উত্তরাধিকার
আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এই শিল্পের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও তাদের পরিবার। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে এই খাত থেকে। এই বিশাল সফলতার পেছনে যে মানুষটির স্বপ্ন এবং সাহস সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে, তিনি হলেন মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন। তার প্রতিষ্ঠিত রিয়াজ গার্মেন্টস হয়তো আজ সময়ের পরিবর্তনে হারিয়ে গেছে, কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মানচিত্রে তারা যে অসামান্য অবদান রেখেছে, তা চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
