দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে টানা দ্বিতীয় দিনে আবারও ধরা পড়ল এক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। নাম তার আমির হামজা, কিন্তু স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন সঞ্জয় মণ্ডল নামে। বছরখানেক নয়, টানা ১১ বছর ধরে ভুয়া পরিচয়ে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছিলেন তিনি।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) বারুইপুরের চম্পাহাটি সোল গোয়ালিয়া এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে স্থানীয় পুলিশ। তার আগের দিন একই এলাকা থেকে ধরা পড়ে আরেক বাংলাদেশি যুবক মোহাম্মদ সুজন মোল্লা। টানা দুদিন ধরে এমন ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশ, তারপর ভুয়া পরিচয়ে জীবন
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে বসিরহাট সীমান্ত পেরিয়ে বেআইনি পথে ভারতে প্রবেশ করেন আমির হামজা। সীমান্ত পেরোনোর পর তিনি সোজা চলে আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার চম্পাহাটি এলাকায় এবং স্থানীয় এক বাসিন্দা গোষ্ঠ মণ্ডলের সাহায্যে নতুন পরিচয় তৈরি করেন।
সেখানেই নিজের নাম বদলে সঞ্জয় মণ্ডল করে ফেলেন তিনি। এরপর তৈরি করেন ভুয়া ভোটার আইডি ও আধার কার্ড, যা ব্যবহার করে তিনি স্থানীয়ভাবে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে পরিচিতি পান।
বছরের পর বছর গা ঢাকা দিয়ে তিনি কৃষিকাজ, নির্মাণকাজ এবং স্থানীয় বিল্ডার্সের দোকানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এলাকায় তাঁকে “নিরীহ, পরিশ্রমী মানুষ” হিসেবেই চিনতেন স্থানীয়রা।
উদ্ধার মিলেছে ভোটার কার্ড, আধার ও দুই দেশের পাসপোর্ট
বারুইপুর থানার পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্তের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে—
- ভুয়া ভোটার আইডি কার্ড (ভারতীয় পরিচয়ে ‘সঞ্জয় মণ্ডল’ নামে)
- আধার কার্ড
- বাংলাদেশ ও ভারতের দুই দেশের পাসপোর্ট
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, দীর্ঘদিন ধরে এভাবে পরিচয় গোপন রেখে তিনি দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম আমির হামজা এবং বাড়ি বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার এক গ্রামে।
তদন্তে উঠে এসেছে, মা এখনও বাংলাদেশেই বসবাস করেন এবং আমির নিয়মিত তাঁর কাছে টাকা পাঠাতেন।
প্রশ্ন: কীভাবে এত বছর প্রশাসনের চোখে ফাঁকি?
এই ঘটনায় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে—
কীভাবে একজন বিদেশি নাগরিক টানা ১১ বছর ধরে ভুয়া পরিচয়ে ভারতের সরকারি নথিপত্র পেতে পারলেন?
স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা সংস্থার চোখে ফাঁকি দিয়ে এমন ঘটনা ঘটায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এক তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা খতিয়ে দেখছি, কীভাবে ও কোথায় তাঁর নথিগুলি তৈরি হয়েছিল। কারা তাঁকে সাহায্য করেছিল, এবং এই জাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে আর কেউ যুক্ত আছে কি না।”
তিনি আরও জানান, জাল পরিচয়পত্র তৈরির পেছনে বড় কোনও চক্র সক্রিয় থাকতে পারে, যা সীমান্ত পারাপার, অবৈধ অভিবাসন ও পাচারকাজের সঙ্গে যুক্ত।
স্থানীয়দের বিস্ময়: “ও যে বাংলাদেশি, তা বুঝতেই পারিনি”
চম্পাহাটির স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই হতবাক। তাঁদের এক প্রতিবেশী বলেন,
“সঞ্জয়দা খুবই শান্ত-শিষ্ট মানুষ ছিলেন। সকালে কাজে যেতেন, বিকেলে ফিরতেন। কখনও ঝামেলা করতে দেখিনি। ও যে বাংলাদেশি, তা বুঝতেই পারিনি।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারের পর পুলিশ যখন তাঁর আসল পরিচয় জানায়, তখন অনেকেই অবিশ্বাসে হতভম্ব হয়ে পড়েন।
পুলিশের তৎপরতা ও পরবর্তী তদন্ত
বারুইপুর থানার পুলিশ ইতিমধ্যেই অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। জানা গেছে, তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি ও বিদেশি নাগরিক আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা এখন খুঁজে দেখছি, তাঁর সঙ্গে কোনও বেআইনি ব্যবসা, অর্থ পাচার বা অপরাধ চক্রের সংযোগ আছে কি না। তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল, নথি ও ব্যাংক লেনদেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
পাশাপাশি তাঁরা স্থানীয় প্রশাসন ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অনুপ্রবেশ রোধ করা যায়।
টানা দুই দিনে দুই বাংলাদেশি গ্রেপ্তার, উদ্বিগ্ন প্রশাসন
গত দুই দিনে একই এলাকা থেকে দুই বাংলাদেশি নাগরিকের গ্রেপ্তার প্রশাসনের কাছে গুরুতর নিরাপত্তা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ উভয়ই এখন বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছে।
এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান,
“আমরা আশঙ্কা করছি, এই অঞ্চলে আরও কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারে। তাদের খুঁজে বের করতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।”
চম্পাহাটি এলাকার এই ঘটনাগুলি আবারও মনে করিয়ে দিল, সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে পরিচয় জালিয়াতি ও অনুপ্রবেশের সমস্যা কতটা গভীর।
একদিকে প্রশাসন দাবি করছে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন রয়ে যায়—
কীভাবে একজন বিদেশি নাগরিক ভোটার আইডি, আধার ও পাসপোর্ট পর্যন্ত সংগ্রহ করে ১১ বছর ধরে নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারেন?


সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited