গাজা যুদ্ধের অবসান ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিশরের লোহিত সাগর তীরের শহর শার্ম আল-শেখে চলছে গুরুত্বপূর্ণ এক কূটনৈতিক আলোচনা। এই বৈঠকে হামাস ও ইসরাইলি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বুধবার থেকে যোগ দিচ্ছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল সানি এবং তুরস্কের গোয়েন্দা প্রধান ইব্রাহিম কালিন।আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যাশা, এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত নিরসনে নতুন এক দিগন্ত খুলতে পারে।
ট্রাম্প প্রস্তাবিত ২০ দফা পরিকল্পনা
এই আলোচনার ভিত্তি তৈরি হয়েছে গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা থেকে। পরিকল্পনাটিতে গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, সব জিম্মির মুক্তি, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং ইসরাইলি সেনা ধীরে ধীরে প্রত্যাহারের রূপরেখা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন,
“আমরা মধ্যপ্রাচ্যে সত্যিকার অর্থে শান্তি প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হামাস ও ইসরাইল যদি যুদ্ধবিরতিতে একমত হয়, যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করবে যাতে সবাই চুক্তি মেনে চলে।”
দুই পক্ষের অবস্থান
হামাসের শীর্ষ আলোচক খলিল আল-হাইয়া জানিয়েছেন, তাদের দল যুদ্ধ স্থায়ীভাবে শেষ করার আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি চাইছে। তিনি বলেন,
“আমরা কেবল যুদ্ধবিরতি নয়, গাজায় স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা চাই।”
অন্যদিকে ইসরাইল বলেছে, জিম্মি মুক্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছাড়া কোনো যুদ্ধবিরতি সম্ভব নয়।
হামাসের ঘনিষ্ঠ এক ফিলিস্তিনি সূত্র জানিয়েছে, মঙ্গলবারের অধিবেশনে আলোচনা হয়েছে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের মানচিত্র, জিম্মি-বন্দী বিনিময়ের প্রক্রিয়া ও সময়সূচি নিয়ে।
আন্তর্জাতিক চাপ ও মানবিক বিপর্যয়
৭ অক্টোবরের হামাস হামলার দ্বিতীয় বার্ষিকী ঘিরে আলোচনাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ওই হামলায় ১,২১৯ জন নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক। হামাস ২৫১ জনকে জিম্মি করে, যাদের মধ্যে এখনও ৪৭ জন বন্দী বলে জানিয়েছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে গাজায় ইসরাইলের পাল্টা হামলায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬৭ হাজার ১৬০ জন, যার অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এই সংখ্যা ‘বিশ্বাসযোগ্য’।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছে। অপরদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য হামাসকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করেছে। তবে উভয় পক্ষই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মিশরের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ
মিশর এই আলোচনার মূল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাত্তি জানিয়েছেন, বুধবার আলোচনায় যোগ দেবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফ।
তিনি বলেন,
“এই আলোচনার প্রাথমিক সাফল্যের গ্যারান্টি হচ্ছেন ট্রাম্প নিজেই। তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা বিষয়টিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।”
কাতার ও তুরস্কও গাজা সংকট নিরসনে বরাবরই সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। কাতারের প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে আলোচনায় উপস্থিত থাকবেন বলে নিশ্চিত করেছে দোহা। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, দেশটির গোয়েন্দা প্রধান ইব্রাহিম কালিনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে মিশরে পৌঁছেছে।
শান্তির আশায় অপেক্ষমাণ বিশ্ব
বিশ্বজুড়ে গাজা যুদ্ধের অবসানের দাবি জোরালো হচ্ছে। একদিকে গাজায় মানবিক বিপর্যয়, অন্যদিকে ইসরাইলি জিম্মি পরিবারের আর্তনাদ—উভয়ই আলোচকদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
যদিও এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি, তবুও কূটনৈতিক মহল বলছে—
এই আলোচনায় কাতার ও তুরস্কের অংশগ্রহণ এক বড় কূটনৈতিক অগ্রগতি।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, “যদি ট্রাম্প প্রশাসন, মিশর, কাতার ও তুরস্ক একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে এই যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন সম্ভব। সেটাই এখন বিশ্বের প্রধান প্রত্যাশা।”
গাজা যুদ্ধের দুই বছর পর এই প্রথমবারের মতো এত সংখ্যক আন্তর্জাতিক শক্তি একই টেবিলে বসছে। মিশরের শার্ম আল-শেখের এই বৈঠক হয়তো হবে একটি স্থায়ী শান্তি প্রক্রিয়ার সূচনা, যা শুধু গাজার নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে।
