বিপদের সময় একটি ফোন কল—যা জীবন বাঁচাতে পারে, নিরাপত্তা দিতে পারে, ফিরিয়ে আনতে পারে আশা। সেই নম্বরটি হলো জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯, যা আজ বাংলাদেশের কোটি মানুষের কাছে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা, অপরাধ কিংবা জীবন-মৃত্যুর সংকট—যে কোনো জরুরি মুহূর্তে ফোনের ওপাশে থাকা কলটেকারদের সাড়া মিলছে দ্রুততম সময়ে।
বিপদের মুহূর্তে জীবনরক্ষার হাত
গত বছর যশোরের রূপদিয়া রেলস্টেশনে এক নারী প্রসববেদনায় কাতর হয়ে পড়েন। স্টেশন মাস্টার বাবুল আক্তার ৯৯৯-এ কল করলে, কোতোয়ালি থানার কনস্টেবল দ্বীন ইসলাম ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ছুটে যান ঘটনাস্থলে। তারা নবজাতক ও প্রসূতিকে নিরাপদে হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই একটি ফোন কলই বাঁচিয়ে দেয় দুইটি জীবন।
ঠিক এমনভাবেই ঢাকা শহরের কদমতলীতে মাদকাসক্তদের হাতে আটকা পড়া এক নারী রিনা বেগমও রক্ষা পান ৯৯৯-এ ফোন করার সুবাদে। তিনি জানান,
“মধ্যরাতে দুই পরিচিত মানুষ বাসায় ঢুকে আচমকা ভয়ানক আচরণ শুরু করে। তখন আমি ৯৯৯-এ ফোন করি। পুলিশ পৌঁছালে তারা পালিয়ে যায়।”
রিনার মতো অসংখ্য মানুষ এখন জানেন, বিপদে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস বা অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে ৯৯৯-ই সর্বশেষ আশ্রয়।
৬ কোটি কল, কোটি মানুষের সেবা
বাংলাদেশ পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে সূচনার পর থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৯৯ নম্বরে মোট ৬ কোটি ৬০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৩টি কল এসেছে।
এর মধ্যে ২ কোটি ৯০ লাখ ৩৯ হাজার ২৪১টি কলকে সরাসরি সেবা প্রদান করা হয়েছে—যার সেবার হার প্রায় ৪৪ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি সেবা দেওয়া হয়েছে পুলিশিং খাতে—১৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫টি কল (৮৩.৫১%), এরপর অ্যাম্বুলেন্স সেবা ৮.৬৮% এবং ফায়ার সার্ভিস ৭.৮%।
৯৯৯-এর প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মহিউল ইসলাম বলেন,
“৯৯৯ এখন জনগণের আস্থার জায়গায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৪ হাজার কল আসে। এর মধ্যে অনেক কল অপ্রয়োজনীয় হলেও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি প্রকৃত বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে।”
অপ্রয়োজনীয় কল—বড় প্রতিবন্ধকতা
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রতিদিন আসা এই বিপুল সংখ্যক কলের মধ্যে প্রায় ৫৬ শতাংশই অপ্রয়োজনীয় বা বিরক্তিকর।
কেউ কৌতূহলবশত ফোন করেন, কেউ মজা করতে। এমনকি অনেক কলেই অশালীন ভাষা বা হয়রানির ঘটনা ঘটে। এতে প্রকৃত জরুরি কলের সেবা বিলম্বিত হয় এবং মানসিক চাপে থাকেন কলটেকাররা।
৯৯৯-এর গণমাধ্যম ও জনসংযোগ কর্মকর্তা আনোয়ার সাত্তার বলেন,
“আমাদের কল গ্রহণ সক্ষমতা মাত্র ৮০টি ইনকামিং লাইনে সীমিত। কিন্তু প্রতিদিনের হাজারো অপ্রয়োজনীয় কল প্রকৃত সেবাপ্রত্যাশীদের সহায়তা দিতে বাধা তৈরি করে। সবাইকে অনুরোধ—জরুরি না হলে ৯৯৯-এ কল করবেন না।”
প্রযুক্তি, জনবল ও অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনা
জরুরি সেবার দক্ষতা ও পরিসর বাড়াতে ৯৯৯ কর্তৃপক্ষ হাতে নিয়েছে বড় আকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা।
বর্তমানে পূর্বাচলে অতিরিক্ত ১০০টি নতুন ওয়ার্কস্টেশন স্থাপনের কাজ চলছে, পাশাপাশি ডেমরার আমুলিয়ায় প্রায় ৫৫২ কোটি টাকার একটি বৃহৎ ওয়ার্কস্টেশন প্রকল্প প্রস্তাব আকারে জমা দেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ৯৯৯-এর সক্ষমতা তিনগুণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে নাগরিকরা আরও দ্রুত ও নির্ভুল সেবা পাবেন।
ডিআইজি মহিউল ইসলাম বলেন,
“নতুন ওয়ার্কস্টেশন স্থাপন হলে প্রতিদিনের কল হ্যান্ডলিং ক্ষমতা কয়েকগুণ বাড়বে। এখন আমাদের হাতে ৮০ জন কল টেকার ও ২০ জন ডিসপ্যাচার রয়েছে, যা প্রতিদিনের ২৪ হাজার কলের তুলনায় অত্যন্ত সীমিত।”
সচেতনতার মাধ্যমে সেবার পরিধি বাড়ানো হচ্ছে
অপ্রয়োজনীয় কল কমাতে এবং সঠিক সময়ে সঠিক সহায়তা নিশ্চিত করতে মিডিয়া ক্যাম্পেইন, সামাজিক প্রচার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করেছে জাতীয় জরুরি সেবা কর্তৃপক্ষ।
পাশাপাশি, তরুণ ও শিক্ষিত কল টেকার নিয়োগ, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সহায়তায় স্থানীয় পর্যায়ে প্রচারণা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হচ্ছে।
‘জরুরি না হলে কল নয়’—জনগণের প্রতি আহ্বান
৯৯৯ কর্তৃপক্ষের অনুরোধ, এই নম্বর কেবল প্রকৃত জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করুন।
যেমন—জীবনহানির আশঙ্কা, দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, অপরাধ, নারী বা শিশুর বিপদ, বা যেকোনো ত্বরিত চিকিৎসা প্রয়োজনের ক্ষেত্রে।
আনোয়ার সাত্তার বলেন,
“প্রকৃত বিপদে থাকা মানুষকে সাহায্যের সুযোগ দিন। ৯৯৯ কেবল একটি নম্বর নয়, এটি এখন মানুষের জীবনরক্ষাকারী হাত।”
📞 ৯৯৯ — বিপদে সবার পাশে, সবসময়।
