বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী শহীদ আবরার ফাহাদ— যিনি আগ্রাসনবিরোধী অবস্থানের কারণে ২০১৯ সালে নির্মম হত্যার শিকার হন, তার স্মৃতিকে চিরজাগরুক রাখতে আজ মঙ্গলবার উদ্বোধন করা হয়েছে ‘আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ’।
বুয়েট সংলগ্ন পলাশী গোলচত্বরে উদ্বোধন করা এই স্মারকটি কেবল একটি স্থাপনা নয়, বরং এটি আবরারের আদর্শ, স্বাধীনতার চেতনা ও জাতীয় মর্যাদার প্রতি নতুন অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে ‘আট স্তম্ভ’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বাস্তবায়নে ‘শহীদ আবরার ফাহাদ স্মৃতি স্মরণে আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ ও পলাশী ইন্টারসেকশন উন্নয়ন’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে নির্মিত হয়েছে এই স্মারক।
‘আট স্তম্ভ’ বাংলাদেশের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, গণপ্রতিরক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, দেশীয় শিল্প–কৃষি–নদী–বন–বন্দর রক্ষা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা— এই আট মৌলিক মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
প্রকল্পটি সম্পন্ন হয়েছে ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয়ে।
“শব্দগুলোই আসল শক্তি”— স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন,
“আট স্তম্ভের অবয়ব নয়, বরং তাতে লেখা শব্দগুলোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই শব্দগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এই বদ্বীপভূমি প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করবে।”
তিনি বলেন,
“ফ্যাসিবাদের সময়ে বিলিয়ন টাকার ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু আজ আমরা দেখছি— ফ্যাসিবাদবিরোধী এক শক্তি সামান্য বাজেটে জনগণের চেতনার স্মারক নির্মাণ করছে। এটিই আসল প্রতিরোধের প্রতীক।”
“আবরার একটি চেতনা, একটি আদর্শ”— ডিএসসিসি প্রশাসক
ডিএসসিসি প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন,
“আবরার ফাহাদ শুধু একজন ব্যক্তি নন; তিনি একটি চেতনা, একটি আদর্শের নাম। তার রক্তের বিনিময়ে জেগে উঠেছে নতুন প্রজন্মের সচেতনতা।”
তিনি আরও বলেন,
“২০১৯ সালে আবরার যে বীজ বপন করেছিলেন, সেটিই আজ একটি মহীরুহে পরিণত হয়েছে। আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পরামর্শক্রমে আমরা এই স্তম্ভ নির্মাণ করেছি।”
“আবরারের স্মৃতি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে”— সচিব রেজাউল মাকছুদ
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন,
“আবরারের ত্যাগ ও চেতনা কেবল বুয়েটের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। তার আদর্শ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।”
তিনি জানান, ভবিষ্যতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আবরারের স্মৃতিচারণে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
পরিবারের আবেগঘন উপস্থিতি
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শহীদ আবরারের পিতা মো. বরকত উল্লাহ ও ভাই আবরার ফাইয়াজ।
তাদের উপস্থিতিতে মুহূর্তটি আবেগঘন হয়ে ওঠে। আবরারের পিতা বলেন,
“আমার সন্তানের নাম আজ শুধু দুঃখের নয়, গৌরবেরও প্রতীক। সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যে সাহস দেখিয়েছে, সেটি এখন দেশের তরুণদের জন্য প্রেরণা।”
বুয়েট ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ।
বক্তারা বলেন, আবরার ফাহাদ ছিলেন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তরুণ কণ্ঠস্বরের প্রতীক। আজ তার নামে নির্মিত এই স্তম্ভ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করবে।
আবরারের চেতনা— প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার কিছু সদস্য।
তখন থেকেই ‘আবরার’ নামটি হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক।
আজ পলাশী গোলচত্বরে স্থাপিত এই ‘আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ’ যেন সেই প্রতিরোধের স্থায়ী স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে— যা আগামী প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেবে, স্বাধীনতা কেবল অর্জনের নয়, রক্ষারও চেতনা।
