দুর্গাপুর ব্যারাজ ও ড্যাম থেকে জল ছাড়ার জেরে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নতুন করে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষত হাওড়া জেলার আমতা–২ ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন প্লাবনের কবলে। ভাটোরা গ্রামপঞ্চায়েতের উত্তর ভাটোরা ও ঘোড়াবেড়িয়া এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
ডিভিসি (দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন) কর্তৃপক্ষ জানায়, মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়া হয়েছে। একই সঙ্গে পূর্ণিমার টানে রূপনারায়ণ ও মুণ্ডেশ্বরী নদীর জলস্তরও বেড়ে গেছে। এতে নিম্নাঞ্চলগুলোতে দ্রুত জল জমতে শুরু করেছে।
পূর্ণিমার টানে নদীর জলে উথালপাথাল
রবিবার রাত থেকেই জলস্তর ধীরে ধীরে বাড়ছিল। তবে সোমবার কোজাগরী পূর্ণিমায় তা একলাফে আরও বৃদ্ধি পায়। স্থানীয়রা জানান, ভাটোরার বিভিন্ন মাঠঘাট, গ্রামীণ সড়ক এবং ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। কোথাও হাঁটু-সমান, কোথাও কোমর-সমান জল।
বিশেষ করে ঘোড়াবেড়িয়া ও উত্তর ভাটোরার অংশে গ্রামের ভেতর দিয়ে যাতায়াত কার্যত বন্ধ।
স্থানীয় বাসিন্দা হরিপদ দে বলেন,
“ধান পাকতে শুরু করেছিল, সবজি ভালো ফলেছে—এমন সময় আবার এই জল। আমরা কিছুই বাঁচাতে পারিনি।”
কৃষকদের মাথায় হাত
গত বছরের ভয়াবহ জলাবদ্ধতার পর এবার আশায় বুক বেঁধেছিলেন কৃষকরা। ধান ও শীতের সবজি চাষে ভালো ফলনের আশা ছিল। কিন্তু অকাল বৃষ্টি ও ড্যাম থেকে জল ছাড়ায় সব স্বপ্ন এখন ভাসছে জলে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানিয়েছেন, মাঠের ধানগাছ এখন পুরোপুরি ডুবে গেছে। যেসব সবজি আগেই তোলা হয়েছিল, সেগুলোও বিক্রির আগে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় কৃষক সমিতির এক সদস্য বলেন,
“এবারই আমরা ঋণ নিয়ে চাষ করেছিলাম। এখন সব শেষ। যদি জল নামতে দেরি হয়, তাহলে একর পর একর জমি নষ্ট হবে।”
প্রশাসনের নজরদারি শুরু
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আমতার বিধায়ক সুকান্ত পাল জানিয়েছেন, প্রশাসন সব সময় মাঠে আছে।
তিনি বলেন,
“জলস্তর বৃদ্ধির বিষয়টি আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি। ব্লক অফিসে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। প্রয়োজনে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে নেমে পড়বে প্রশাসন।”
হাওড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, রূপনারায়ণ নদীর প্রবাহ পর্যবেক্ষণে বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। যেসব এলাকায় বাঁধ দুর্বল, সেখানে মজবুতির কাজ শুরু হয়েছে।
নদীর সঙ্গে ড্যামের সমন্বয় জরুরি
বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণবঙ্গের জলপথগুলো পরস্পর সংযুক্ত। দামোদর নদী দিয়ে ড্যামের জল ছাড়লে তার প্রভাব পড়ে রূপনারায়ণ, শীলাই ও মুণ্ডেশ্বরী নদীতেও।
পরিবেশবিদ অরুণাভ ভট্টাচার্য বলেন,
“প্রতি বছরই একই চিত্র দেখা যায়। ডিভিসি কখন জল ছাড়বে, তা আগাম জানিয়ে নদীপথে সুষ্ঠু নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করলে বন্যা অনিবার্য।”
ভাটোরার ঘরবন্দি মানুষ
উত্তর ভাটোরায় ইতিমধ্যে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। অনেক পরিবার ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। নৌকা দিয়ে খাবার ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। স্কুলগুলোর নিচতলা জলে ডুবে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পাঠদান বন্ধ রাখতে হয়েছে।
দক্ষিণ ভাটোরা ও ঘোড়াবেড়িয়া চিতনানের কিছু অংশে বড় রাস্তাগুলো এখনও চলাচলযোগ্য থাকলেও আশঙ্কা রয়েছে—জল বাড়লে সেগুলিও অচল হয়ে যাবে।
সতর্ক বার্তা ও পরামর্শ
প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের অনুরোধ করা হয়েছে, নদীর পাড় বা জলাধারের ধারে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
ডিভিসি জানিয়েছে, আবহাওয়ার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ধীরে ধীরে জল ছাড়ার প্রক্রিয়া চলবে।
বৃষ্টির দাপট ও ড্যাম থেকে জল ছাড়ায় দক্ষিণবঙ্গের কৃষকদের সামনে আবারও অনিশ্চয়তা। যদিও প্রশাসন জানিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কৃষকদের এখন একটাই আশা—জল যেন দ্রুত নেমে যায়, যাতে অন্তত আংশিকভাবে ফসল বাঁচানো সম্ভব হয়।
সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited