কালীপুজো ও দীপাবলিকে ঘিরে প্রতিবছরই শব্দবাজির আতঙ্ক ঘনিয়ে আসে শহরজুড়ে। নিষিদ্ধ বাজি আটকাতে পুলিশ প্রশাসন কঠোর অবস্থানে গেলেও অনেক সময়ই দেখা যায়, বাড়ির উঠোনে বা আবাসনের ছাদে ফাটছে কানে-বিদারক চকলেট বোমা কিংবা শক্তিশালী পটকা। আর এসবের নেপথ্যে থাকে শিশু-কিশোররাই।
বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এবার তাই ধমক নয়, বোঝানো ও শেখানোতেই জোর দিচ্ছে কলকাতা পুলিশ। উৎসবের আগে আবাসন ও পাড়াভিত্তিক শিশুদের নিয়ে আয়োজন করা হবে ‘নিরাপদ উৎসব কর্মশালা’। পুলিশের সঙ্গে থাকবে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও।
আবাসনে কর্মশালার পরিকল্পনা
লালবাজার সূত্রে জানা গেছে, শহরের বিভিন্ন আবাসনে শিশু-কিশোরদের নিয়ে চলবে এই কর্মশালা। সেখানে শিশুদের সামনে তুলে ধরা হবে ভিডিও ও পোস্টারের মাধ্যমে নিষিদ্ধ বাজির ক্ষতিকর দিক, নিরাপদ বাজির ধরন, এবং সতর্কতার নিয়মাবলি।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কেবল বাজি জব্দ বা জরিমানার চেয়ে সচেতনতা গড়ে তোলাই স্থায়ী সমাধান। এক সিনিয়র অফিসারের ভাষায়—
“আমরা এবার ভয় দেখিয়ে নয়, ভালোবেসেই বোঝাতে চাই শিশুদের। ওরা যদি বুঝে যায় বিপদের দিকটা, তাহলে নিজেরাই অন্যদেরও আটকাবে।”
বাজির দাপট ও দুর্ঘটনার স্মৃতি
গত বছর কালীপুজোর রাতে কসবার এক আবাসনে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। চকলেট বোমা ফাটাতে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর হাত পুড়ে যায় মারাত্মকভাবে। নিউ আলিপুরেও নিষিদ্ধ বাজিতে আহত হয় এক কিশোরী।
পরিবেশকর্মীদের হিসেবে, ২০২৪ সালের দীপাবলিতে শুধু কলকাতায়ই অন্তত সাতজন শিশু-কিশোর আহত হয়েছিল বাজির ঘটনায়। অনেকের চোখ, কানের ক্ষতি হয়; কেউ কেউ স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি হারায়।
পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বলেন,
“শব্দবাজি কেবল শব্দ দূষণ নয়, এটা মানুষের মানসিক শান্তি, প্রাণীজগৎ আর পরিবেশের জন্যও বিপজ্জনক। শিশুদের মধ্যেই পরিবর্তনের শুরু হলে পরিবারগুলোও সচেতন হবে।”
অভিভাবকদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ
কর্মশালায় শুধু শিশু নয়, অভিভাবকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হবে। পুলিশ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিশুদের চেয়ে অভিভাবকরাই বেশি প্রভাবিত করতে পারেন উৎসবের আচরণে পরিবর্তন আনতে।
কর্মশালায় তুলে ধরা হবে বাজির জেরে সৃষ্ট দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও রক্তসঞ্চালন সমস্যা সংক্রান্ত তথ্যচিত্র। এতে চিকিৎসক ও পরিবেশবিদদের ব্যাখ্যায় বোঝানো হবে, কীভাবে একটি ক্ষণিকের আনন্দ দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
পরিবেশবান্ধব উৎসবের পথে
কলকাতা পুলিশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জানিয়েছে, শহরে ‘গ্রিন ক্র্যাকার’ ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হবে। এ ধরনের বাজি স্বল্প শব্দে ও কম দূষণে ফাটানো যায়। আবাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব বিষয় নিয়ে বিশেষ প্রচার চালানো হবে।
পর্ষদের এক কর্মকর্তা জানান,
“আমরা চাই, উৎসব হোক আনন্দের, আতঙ্কের নয়। শব্দবাজির বিকল্প আছে—শুধু সচেতনতার অভাবেই অনেকে তা জানেন না।”
কঠোর নজরদারিও থাকবে
যদিও পুলিশ বলছে সচেতনতাই প্রধান, তবে নজরদারি কমবে না। দীপাবলির আগেই প্রতিটি থানায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে। শহরে নিষিদ্ধ শব্দবাজি ঢুকতে না পারে, সেজন্য সীমান্তবর্তী বাজার ও পাইকারি দোকানগুলোয় চলছে নজরদারি।
এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন,
“শিক্ষা আর শাস্তি—দুটোই প্রয়োজন। কিন্তু আমরা চাই, এই উদ্যোগে শিক্ষা যেনই আগে আসে।”
শব্দবাজি নিয়ে প্রশাসনের এই মানবিক উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন পরিবেশকর্মী ও নাগরিক সংগঠনগুলো। তারা বলছেন, শিশুদের মাধ্যমে সচেতনতা ছড়িয়ে দিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মই তৈরি করবে “নিরাপদ ও দূষণমুক্ত উৎসব সংস্কৃতি”।
