দুর্গাপুজোর উৎসব মানেই কলকাতার রাস্তায় জনস্রোত, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঢল নামা মানুষের। কিন্তু এই ভিড় সামলে শহরের অন্যতম প্রধান গণপরিবহন—কলকাতা মেট্রো—প্রমাণ করেছে তার সক্ষমতা। পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত ছয় দিনেই কলকাতা মেট্রোর চারটি রুটে (ব্লু, গ্রিন, ইয়েলো ও পার্পল লাইন) মোট ৪৬ লাখ ৫৬ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেছেন—যা এবারের পুজোয় নতুন রেকর্ড।
মেট্রোর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, উৎসবের এই ব্যস্ত সময়টিকে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ হিসেবে দেখা হয়েছিল। কারণ প্রতি বছরই কখনো যান্ত্রিক ত্রুটি, কখনো সিগন্যাল বিভ্রাট বা অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে বিপাকে পড়ে কলকাতা মেট্রো। কিন্তু এ বছর সেই ইতিহাস ভেঙে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি—পুরো পুজোর সময়কালেই একটিও বড় ধরনের পরিষেবা বিঘ্ন ঘটেনি।
সেরা স্টেশন কালীঘাট, এরপর দমদম ও শোভাবাজার
বর্তমানে কলকাতা মেট্রোর চারটি লাইনে মোট ৪৯টি স্টেশন চালু রয়েছে। এর মধ্যে পুজোর দিনগুলোয় যাত্রী পরিবহনের দিক থেকে কালীঘাট স্টেশন পেয়েছে প্রথম স্থান। শুধু কালীঘাট দিয়েই এই সময়ে যাতায়াত করেছেন চার লাখ ছয় হাজার যাত্রী।
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দমদম স্টেশন, যেখান দিয়ে যাতায়াত করেছেন প্রায় তিন লাখ পঁচানব্বই হাজার মানুষ। আর তৃতীয় স্থানে আছে শোভাবাজার–সুতানুটি স্টেশন, যেখান দিয়ে যাত্রী ছিলেন দুই লাখ আটাশি হাজার।
এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে, দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত শহরের সর্বত্রই মেট্রোর ব্যবহার ক্রমবর্ধমান, এবং উৎসবের সময়েও যাত্রীদের প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছে এই রেল নেটওয়ার্ক।
যান্ত্রিক গোলযোগহীন সেবা—বিরল সাফল্য
গত কয়েক বছরে মেট্রো রেল পরিষেবায় যান্ত্রিক ত্রুটি যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ব্লু লাইন হোক বা গ্রিন লাইন—যাত্রীরা প্রায়ই অভিযোগ করেছেন ট্রেন বন্ধ থাকা, দরজা না খোলা, বা বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে বিলম্বের। এমন সপ্তাহও গেছে, যখন তিন দিন পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে।
তাই এবারের দুর্গাপূজা ছিল কলকাতা মেট্রোর কাছে বড় এক চ্যালেঞ্জ। প্রচণ্ড যাত্রীচাপ, দীর্ঘ সময়ের পরিষেবা ও শহরজুড়ে উৎসবের ভিড়ের মাঝেও যেন সবকিছু মসৃণভাবে চলে—সেই লক্ষ্যেই মাসখানেক আগে থেকেই বিশেষ প্রস্তুতি নেয় মেট্রো কর্তৃপক্ষ।
ফল মিলেছে হাতেনাতে—পুজোর পুরো সময় ধরে কোনো বড় ত্রুটি বা পরিষেবা বন্ধের ঘটনা ঘটেনি। যাত্রীদের সন্তুষ্টিও ছিল চোখে পড়ার মতো।
একদিনেই প্রায় দশ লাখ যাত্রী—নতুন ইতিহাস
রেকর্ড শুধু ছয় দিনের যাত্রীসংখ্যাতেই নয়, একদিনের যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রেও নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে কলকাতা মেট্রো।
চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর—অর্থাৎ শষ্ঠীর দিন—মেট্রো ব্যবহার করেন প্রায় নয় লাখ ৮২ হাজার যাত্রী। এতদিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহনের রেকর্ড ছিল ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবরের, যখন যাত্রীসংখ্যা ছিল নয় লাখ ৬০ হাজার।
অর্থাৎ ২০২৫ সালের পুজোয় আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে কলকাতা মেট্রো, যা সংস্থাটির ইতিহাসে একদিনে সর্বাধিক যাত্রী পরিবহনের নতুন মাইলফলক।
সাফল্যের পেছনে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা
মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানায়, এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে পরিকল্পনা, সমন্বয় এবং মেট্রোর প্রতিটি কর্মীর নিরলস পরিশ্রম। ট্রেনচালক থেকে শুরু করে সিগন্যাল অপারেটর, টিকিট কাউন্টার কর্মী, সিকিউরিটি ও স্টেশন ম্যানেজার—সবাই কাজ করেছেন একসঙ্গে।
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা জানতাম পুজোর সময় হবে আমাদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। তাই প্রতিটি বিভাগকে সমন্বয় করে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। তারই ফল, একটিও বড় ত্রুটি ছাড়াই আমরা সফলভাবে পুজো পার করেছি।”
মেট্রো সূত্রে আরও জানা গেছে, উৎসবের দিনগুলোয় ট্রেন চলাচলের সময়সীমা কিছুটা বাড়ানো হয়েছিল এবং বিশেষ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে রিয়েল-টাইম মনিটরিং করা হয় ট্রেনগুলোর গতিবিধি।
যাত্রী সন্তুষ্টি—সবচেয়ে বড় অর্জন
প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ যাতায়াত করলেও অভিযোগের সংখ্যা ছিল ন্যূনতম। অনেক যাত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেট্রো কর্তৃপক্ষের দক্ষতা ও সময়নিষ্ঠতার প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ লিখেছেন, “এবারের পুজোয় মেট্রো ছাড়া এতটা দূর যাওয়া সম্ভবই ছিল না।”
সব মিলিয়ে, দুর্গাপুজোর এই ছয় দিন প্রমাণ করে দিয়েছে—কলকাতা মেট্রো শুধু একটি পরিবহন নয়, শহরের প্রাণপ্রবাহ।
