গাজা উপত্যকায় চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানে নতুন করে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী দেশ মিশর। ইসরাইলি সরকারের এক মুখপাত্র রোববার রাতে জানিয়েছেন, তাদের আলোচক দল মিশরের রাজধানী কায়রোতে পৌঁছাচ্ছে, যেখানে সোমবার থেকে হামাসের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনা শুরু হবে।
জেরুজালেম থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ইসরাইল সরকারের মুখপাত্র শোশ বদ্রোশিয়ান বলেন, “ইসরাইলি প্রতিনিধিদল আজ রাতে রওনা দেবে এবং আগামীকাল (সোমবার) থেকে আলোচনা শুরু হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।” তিনি আরও জানান, আলোচনাটি মূলত “প্রযুক্তিগত প্রকৃতির,” অর্থাৎ এতে মানবিক সহায়তা, বন্দি বিনিময় এবং যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা হবে।
গাজা পরিস্থিতি: মানবিক সংকট চরমে
ইসরাইল-হামাস সংঘাতের এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো গাজায় মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজা উপত্যকার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত, এবং খাদ্য, পানি, ও চিকিৎসা সামগ্রী ঘাটতি তীব্র আকার ধারণ করেছে। হাসপাতালগুলো বিদ্যুৎ ও ওষুধের অভাবে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বলেন, “গাজায় এখন যা ঘটছে, তা মানবিক বিপর্যয়। যুদ্ধ থামাতে অবিলম্বে কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
মিশরের মধ্যস্থতা: নতুন করে আশার আলো
গাজা সংকটের শুরু থেকেই মিশর গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসছে। কায়রো একদিকে ইসরাইলের নিরাপত্তা স্বার্থ বিবেচনা করছে, অন্যদিকে গাজার মানবিক পরিস্থিতি সামাল দিতে হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এর আগে গত জুন মাসেও মিশরের উদ্যোগে যুদ্ধবিরতি আলোচনার একটি ধাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যদিও তা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি।
মিশরীয় কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এবারের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারও পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, “গাজায় বেসামরিক প্রাণহানি রোধ এবং দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র মিশরের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করছে।”
বন্দি বিনিময় ও যুদ্ধবিরতি আলোচনায় গুরুত্ব
আলোচনার মূল এজেন্ডায় রয়েছে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন, হামাসের হাতে থাকা ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তি এবং গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত করা। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ‘হারেটজ’ জানায়, মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীরা ইতোমধ্যে হামাসের কাছে প্রাথমিক প্রস্তাব পাঠিয়েছে, যাতে ধাপে ধাপে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে, হামাসের রাজনৈতিক দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমরা যুদ্ধবিরতির পক্ষে, তবে সেটি হতে হবে স্থায়ী ও মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিতকারী চুক্তির অংশ।”
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় ইসরাইলি অভিযানের তীব্রতা এবং আন্তর্জাতিক চাপ এই আলোচনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এখন যুদ্ধবিরতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।
বিশ্বের দৃষ্টি এখন কায়রোর দিকে
আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের মতে, কায়রো আলোচনাই গাজা সংকট নিরসনের সম্ভাব্য পথ খুলে দিতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, “যদি মিশরের প্রচেষ্টা সফল হয়, তাহলে এটি হবে মধ্যপ্রাচ্যে গত এক দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শান্তি উদ্যোগ।”
রাশিয়া ও তুরস্কও আলোচনাকে স্বাগত জানিয়েছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা আশা করি এই সংলাপ গাজার জনগণের জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করবে।”
ইসরাইলের অভ্যন্তরে ভিন্নমত
তবে ইসরাইলের ভেতরে এ আলোচনা নিয়ে বিভক্ত মত দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যেখানে ‘জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় কঠোর অবস্থান’ বজায় রাখার পক্ষে, সেখানে বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো যুদ্ধবিরতির পক্ষে জনমত গড়ে তুলছে। তেল আবিবে রোববার রাতে হাজারো মানুষ শান্তি দাবি করে বিক্ষোভ করেছে।
গাজায় অব্যাহত যুদ্ধের মাঝে এই নতুন আলোচনাকে অনেকেই শেষ আশার আলো হিসেবে দেখছেন। তবে আলোচনার ফল নির্ভর করবে উভয় পক্ষের সদিচ্ছা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের ওপর।
