দেশের বিভিন্ন জেলায় গবাদিপশুর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স (তড়কা) রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সারাদেশে জরুরি ও সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রোগটির বিস্তার রোধ ও নিয়ন্ত্রণে টিকাদান, সচেতনতা বৃদ্ধি, পশু স্বাস্থ্য পরীক্ষা, উঠান বৈঠক, পথসভা এবং তথ্য প্রচার কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
অ্যানথ্রাক্স একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত জুনোটিক রোগ, যা গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক মুখপাত্র জানান, “অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে আমরা দ্রুত মাঠ পর্যায়ে নামছি। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে টিকাদান, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অসুস্থ পশু জবাই প্রতিরোধে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।”
টিকাদান ও সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, আক্রান্ত এলাকার প্রতিটি খামারে গবাদিপশুর টিকাদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি ‘ওয়ান হেলথ’ কর্মসূচির আওতায় স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও ভেটেরিনারি টিম নিয়মিত উঠান বৈঠক, প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং পথসভা আয়োজন করছেন।
গবাদিপশুর মালিকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে —
- অসুস্থ পশু জবাই না করা,
- মৃত পশুকে খোলা স্থানে বা পানিতে না ফেলা, বরং গভীরভাবে মাটিচাপা দেয়া,
- এবং কোনো পশু অসুস্থ হলে দ্রুত নিকটস্থ ভেটেরিনারি হাসপাতাল বা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন ও লিফলেটের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে সচেতনতা কার্যক্রমও জোরদার করা হয়েছে।
রংপুর ও গাইবান্ধায় বিশেষ নজর
রোগের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি থাকায় রংপুর ও গাইবান্ধা জেলাকে অ্যানথ্রাক্সপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। ইতোমধ্যে সেখানে বিশেষ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এলআরআই) থেকে রংপুর বিভাগে প্রায় ৩০ লাখ অ্যানথ্রাক্স টিকা সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে রংপুর ও গাইবান্ধায় যাবে প্রায় ২০ লাখ টিকা।
রংপুর জেলার নয়টি উপজেলায়—
পীরগাছা (৫৩,৪০০), কাউনিয়া (৩৪,০০০), রংপুর সদর (২৬,৫০০), মিঠাপুকুর (৩৪,৫০০), গংগাচড়া (৪,৮০০), তারাগঞ্জ (৪,৩০০), বদরগঞ্জ (৫,০০০) ও পীরগঞ্জে (৫,০০০)—এ পর্যন্ত ১ লাখ ৬৭ হাজার গবাদিপশুর টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে।
এছাড়া, জেলায় ৩৬টি কসাইখানায় পশু স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ৩৬টি মেডিক্যাল টিম এবং টিকাদান কার্যক্রম তদারকিতে ৩২টি বিশেষ ভেটেরিনারি টিম গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি উঠান বৈঠক, প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও মতবিনিময় সভা নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে।
গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ২৬ হাজার ৪০০ গবাদিপশুর শরীরে টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। আক্রান্ত এলাকায় মৃত পশু দ্রুত মাটিচাপা দেয়া, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও টিকাদান কার্যক্রম একযোগে সম্পন্ন করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ৫টি ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম গঠন করেছে, যারা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছে।
‘ওয়ান হেলথ’ কৌশলে সমন্বিত ব্যবস্থা
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ‘ওয়ান হেলথ’ কর্মসূচির আওতায় স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা হচ্ছে। এ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশ—এই তিনের স্বাস্থ্যকে একই সঙ্গে সুরক্ষিত রাখা। এজন্য স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও কৃষি বিভাগ এবং এনজিওগুলোকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, “অ্যানথ্রাক্স একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। সচেতনতা ও টিকাদান কার্যক্রম জোরদার থাকলে এ রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সতর্কতা
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, মাঠপর্যায়ের সকল কর্মকর্তাকে জরুরি প্রস্তুতিতে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে অগ্রিম টিকাদান ও রোগ শনাক্তকরণ ল্যাবরেটরি কার্যক্রম বাড়ানো হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্কুল, মসজিদ ও স্থানীয় বাজারে প্রচার কার্যক্রমও অব্যাহত থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত টিকাদান ও সঠিক পশু ব্যবস্থাপনা থাকলে অ্যানথ্রাক্স আর জনস্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে না। সরকারও বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।
