চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই–আগস্ট) দেশের আমদানি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে মোট ১ হাজার ১৪৮ কোটি ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৮ কোটি ডলার বা ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।
২০২৩–২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছিল ১ হাজার ৬০ কোটি ডলারের, অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার আমদানি কার্যক্রমে দৃশ্যমান গতি এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফেরা এবং আমদানি নীতি সহজ হওয়ার প্রভাবেই এলসি খোলায় এই বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ভোগ্যপণ্য আমদানিতে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলায় সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা হয়েছে ৯৯ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য স্থিতিশীল হওয়ায় এবং স্থানীয় ভোগ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায়ীরা নতুন করে এলসি খোলায় আগ্রহী হয়েছেন।
মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্প কাঁচামালে ধীর গতি
অন্যদিকে মূলধনি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে এলসি খোলা তুলনামূলকভাবে ধীর। এ খাতে এলসি খোলা হয়েছে ২৬ কোটি ৪১ লাখ ডলার, যা আগের সময়ের তুলনায় মাত্র শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি।
শিল্প কাঁচামালের এলসি খোলা বেড়েছে ৩ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি ডলারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহজনিত সমস্যা এবং বাজারে চাহিদা অনিশ্চয়তার কারণে বড় আকারের নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়েছে।
পেট্রোলিয়াম আমদানিতে সামান্য বৃদ্ধি
প্রথম দুই মাসে পেট্রোলিয়াম আমদানির এলসি বেড়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এ খাতে এলসি খোলা হয়েছে ১৪৪ কোটি ডলারের।
বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক তেলের দামে সামান্য ওঠানামা ও স্থানীয় জ্বালানি সরবরাহের পরিকল্পিত বৃদ্ধি এই বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে।
মধ্যবর্তী পণ্যে পতন
অন্যদিকে মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে—১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। এই খাতে এলসি খোলা হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ডলারে।
অর্থনীতিবিদদের ব্যাখ্যা, দেশে কিছু শিল্প খাতে উৎপাদন কমে যাওয়া, রপ্তানি আদেশের মন্দাভাব এবং মজুদপণ্যের অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে ব্যবসায়ীরা আপাতত নতুন করে এলসি খোলায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন।
অন্যান্য পণ্যে ইতিবাচক প্রবণতা
‘অন্যান্য পণ্য’ ক্যাটাগরির এলসি খোলা বেড়েছে ১৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এই খাতে খোলা হয়েছে ৩৬১ কোটি ডলারের এলসি। এতে বোঝা যায়, বৈচিত্র্যময় শিল্প খাতে বিনিয়োগ ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ধীরে ধীরে গতিশীল হচ্ছে।
গভর্নরের বৈঠকে আশাবাদ
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দেশের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক শীর্ষ ২০ ব্যবসায়ী গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি জানান, বর্তমানে ডলারের দর স্থিতিশীল এবং বাজারে কোনো সংকট নেই।
তিনি বলেন,
“ডলারের দর স্থিতিশীল থাকায় আমদানির চাপ সঠিকভাবে সামাল দেওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
গভর্নর আরও আশা প্রকাশ করেন, ডলার সংকটমুক্ত পরিবেশে ব্যবসায়ীরা আগের মতো সহজে পণ্য আমদানি করতে পারবেন, যা স্থানীয় বাজারে সরবরাহ বাড়াবে এবং সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
অর্থনীতিতে ইতিবাচক ইঙ্গিত
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এলসি খোলার এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেশের বাণিজ্য পুনরুদ্ধারের প্রাথমিক সংকেত। তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন, শুধু আমদানি বাড়লেই চলবে না—পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও টেকসইভাবে বাড়াতে হবে। অন্যথায় বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্যে চাপ তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “এলসি বৃদ্ধির বিষয়টি অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরার ইঙ্গিত দেয়। তবে এটি যেন অস্থায়ী প্রবণতা না হয়, সে বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের সচেতন থাকতে হবে।”
সব মিলিয়ে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এলসি খোলার গতি অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধারের আশাবাদ তৈরি করেছে। তবে আগামী মাসগুলোতে এই ধারা টিকিয়ে রাখা এবং রপ্তানি খাতকে সমানতালে সক্রিয় রাখা—এখন নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
