বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বৈঠক করেছেন।
শনিবার (৪ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আবাসিক সমন্বয়কারীর সিনিয়র হিউম্যান রাইটস অ্যাডভাইজার হুমা খান। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, সাংগঠনিক সম্পাদক ও পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশেষ সহযোগী উপদেষ্টা কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠক
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন উত্তাপ বেড়েছে, তখন এই বৈঠককে রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
জাতিসংঘ গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের শীর্ষ এই কূটনীতিকের বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎকে কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বৈঠক শেষে বিএনপি সূত্র জানায়, আলোচনায় দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার পরিস্থিতি, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতা এবং আগামী নির্বাচনকে ঘিরে জাতিসংঘের প্রত্যাশা—এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
এক শীর্ষ বিএনপি নেতা বলেন, “জাতিসংঘ চায় বাংলাদেশে এমন একটি নির্বাচন হোক, যেখানে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিতে পারে। আমরা সেই অবস্থানই তুলে ধরেছি—নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়।”
মানবাধিকার ইস্যুতেও আলোচনা
বৈঠকে বিএনপি নেতারা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতা, দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার এবং বিভিন্ন মামলায় হয়রানির অভিযোগের বিষয়ও জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সামনে তুলে ধরেন।
সূত্র জানায়, জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) প্রতিনিধি হুমা খান বিএনপি নেতাদের কাছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার আহ্বান জানান এবং মানবাধিকার সংরক্ষণে পারস্পরিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
একই সঙ্গে বিএনপি নেতারা জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের কাছে গণসমাবেশে হামলা, গণগ্রেপ্তার ও গুম-খুনের অভিযোগে নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন।
বিএনপির দাবি: নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে—বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ প্রশাসন গঠন করবে। দলটির অভিযোগ, “অতীতের মতো প্রশাসনিক প্রভাবিত নির্বাচন হলে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে না।”
বৈঠকে এই বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পক্ষে, এবং এ লক্ষ্যেই সব আন্তর্জাতিক অংশীদারের সঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রাখবে।
এক নেতা বলেন, “জাতিসংঘকে আমরা জানিয়েছি, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহনশীলতা ও পারস্পরিক সংলাপের পরিবেশ তৈরি না হলে কোনও নির্বাচনই বিশ্বাসযোগ্য হবে না।”
জাতিসংঘের ভূমিকা
জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারী অফিস সাধারণত বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে, তবে নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন সরাসরি বৈঠক কূটনৈতিক মহলে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
পূর্ববর্তী বছরগুলোতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠানো, মানবাধিকার মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রণয়ন এবং রাজনৈতিক সংলাপে সহায়তা প্রদানের নজির রয়েছে।
এক কূটনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “গোয়েন লুইসের এই সাক্ষাৎ জাতিসংঘের ‘ডিপ্লোম্যাটিক এনগেজমেন্ট’ কৌশলের অংশ। তারা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলছে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা বা অস্থিতিশীলতা এড়ানো যায়।”
আগামীতে আরও সংলাপের সম্ভাবনা
বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, জাতিসংঘের প্রতিনিধির সঙ্গে এই বৈঠক ছিল ‘প্রাথমিক পর্যালোচনামূলক বৈঠক’। আগামী সপ্তাহে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে।
বৈঠক শেষে কোনও পক্ষই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে গুলশান কার্যালয় সূত্র বলেছে, “জাতিসংঘ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে, এবং বিএনপি তাদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাবে।”
