দেশের স্বর্ণবাজারে আবারও রেকর্ড। বেড়েছে সব মানের স্বর্ণের দাম, ছুঁই ছুঁই করছে দুই লাখ টাকার ঘর। আজ শনিবার (৪ অক্টোবর) বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) নতুন দরের ঘোষণা দিয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বাজুসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের (পাকা স্বর্ণ) দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ২ হাজার ১৯২ টাকা বাড়ানো হয়েছে। নতুন এ দরে এখন ভালো মানের ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি বিক্রি হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৭৬ টাকায়। নতুন দাম কার্যকর হবে রোববার (৫ অক্টোবর) থেকে।
এর আগে সর্বশেষ ২৯ সেপ্টেম্বর স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সেই সময় প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণ বিক্রি হতো ১ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৪ টাকায়। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় দুই হাজার টাকা বেড়ে নতুন উচ্চতায় উঠল স্বর্ণের দাম, যা দেশের ইতিহাসে রেকর্ড।
সব মানের স্বর্ণেই দামবৃদ্ধি
বাজুসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শুধু ২২ ক্যারেট নয়—সব মানের স্বর্ণের দামই বেড়েছে।
- ২১ ক্যারেটের স্বর্ণে ভরিপ্রতি দাম বেড়েছে ২ হাজার ১৩০ টাকা, এখন বিক্রি হবে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৯৫ টাকায়।
- ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণে দাম বেড়েছে ১ হাজার ৭৯৬ টাকা, নতুন দর ১ লাখ ৬১ হাজার ৬৫১ টাকা।
- আর তেজাবি স্বর্ণের (পাকা স্বর্ণ) ভরি বিক্রি হবে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৮ টাকায়।
তবে, রূপার বাজারে কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট রূপা ২ হাজার ৮১৫ টাকা, ২১ ক্যারেট ২ হাজার ৬৭৭ টাকা, এবং ১৮ ক্যারেট রূপা ২ হাজার ২৯৩ টাকায় বিক্রি হবে বলে জানিয়েছে বাজুস।
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব ও ডলারের সংকট
স্বর্ণের দাম বাড়ার পেছনে দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবও বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ববাজারে বর্তমানে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে প্রায় ২,৪৫০ মার্কিন ডলার, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
বাংলাদেশে ডলারের সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারেও দাম দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। বাজুস বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই দেশীয় বাজারে এই সমন্বয় করা হয়েছে।
ভোক্তাদের হতাশা, বিক্রেতাদের উদ্বেগ
স্বর্ণের দামের এই ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
মতিঝিলের এক ক্রেতা বলেন, “বিয়ের কেনাকাটার জন্য কিছুদিন ধরে স্বর্ণ দেখছিলাম। এখন তো প্রতি ভরি প্রায় দুই লাখ টাকার কাছাকাছি। মধ্যবিত্তদের পক্ষে কেনা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে।”
অন্যদিকে, স্বর্ণ বিক্রেতারাও বলছেন, দাম বাড়লেও বিক্রি কমে গেছে। নিউ মার্কেট এলাকার এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেন, “গত এক বছরে প্রায় ১০ বার স্বর্ণের দাম বেড়েছে। ক্রেতারা এখন শুধু জেনে যাচ্ছেন, কিনছেন না। বিক্রি কমে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।”
বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে স্বর্ণ
অন্যদিকে, অর্থনীতিবিদদের মতে, অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রাস্ফীতি ও টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে অনেকেই স্বর্ণকে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক একরামুল হক বলেন,
“স্বর্ণ এখন কেবল অলঙ্কার নয়, এক ধরনের নিরাপদ সম্পদ। মুদ্রার অবমূল্যায়নের সময় অনেকে টাকা রেখে না দিয়ে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছেন।”
তিনি আরও বলেন, “যতদিন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়বে এবং ডলার সংকট থাকবে, ততদিন দেশে স্বর্ণের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে।”
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দর
স্বর্ণের দাম সর্বশেষ এক বছরে প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২3 সালের মাঝামাঝি সময়ে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকার নিচে। এখন তা প্রায় ২ লাখ ছুঁই ছুঁই।
এমন অবস্থায় বাজুসের নতুন ঘোষণা দেশের স্বর্ণবাজারকে নিয়ে গেছে এক নতুন উচ্চতায়।
রেকর্ডমূল্যের এই স্বর্ণ এখন স্বপ্নের পণ্যে পরিণত হয়েছে মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের কাছে।
তবে বিনিয়োগকারীদের কাছে এটি এখনো ‘নিরাপদ আশ্রয়’—যেখানে অর্থের মান হারায় না, বরং সময়ের সঙ্গে বাড়ে।
সর্বশেষ হিসাবে:
২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি — ১,৯৭,৫৭৬ টাকা
২১ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি — ১,৮৮,৫৯৫ টাকা
১৮ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি — ১,৬১,৬৫১ টাকা
রূপা — অপরিবর্তিত
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রতি মাসে একাধিকবার স্বর্ণের দাম বাড়াচ্ছে বাজুস। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, ডলার ও আমদানি খরচ না কমলে সামনে আরও এক দফা স্বর্ণের দাম বাড়তে পারে।
