দুর্গাপুজোর আনন্দের মধ্যেই চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা। মহাষ্টমীর রাতে হাওড়ার বনবিহারী বসু লেনের ব্যস্ত সন্ধ্যাবাজার এলাকায় দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হলেন বিহারের ব্যবসায়ী সুরেশ যাদব (৫৫)। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে এই শুটআউটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে এলাকাজুড়ে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, পুজোর সময় হাওড়া ঘুরতে এসেছিলেন সুরেশ যাদব। হেঁটে যাচ্ছিলেন বনবিহারী বসু লেন দিয়ে। ঠিক তখনই বাইকে করে আসা দুই দুষ্কৃতী তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তিন রাউন্ড গুলি ছোড়া হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন সুরেশ। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
পূর্বপরিকল্পিত হামলার সন্দেহ
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ ধারণা করছে, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হাওড়া সিটি পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন,
“সুরেশ যাদবের আগমন সম্পর্কে আগেই খবর পেয়েছিল দুষ্কৃতীরা। তাই আগে থেকেই ওঁকে লক্ষ্য করে হামলার পরিকল্পনা করা হয়।”
জানা গেছে, সুরেশ যাদবের বাড়ি বিহারের গোপালগঞ্জে। তাঁর স্ত্রী স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান। ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক যোগসূত্রে তাঁর প্রভাবও ছিল উল্লেখযোগ্য।
হাওড়া পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে আরও তথ্য—দু’দিন আগে হাওড়ায় এসেছিলেন সুরেশ। কালিতলা এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে তিনি নিয়মিত থাকতেন। পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, বিহারে তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় দু’ডজন মামলা রয়েছে এবং তিনি প্রায় সাত বছর জেল খেটেছেন। বছর দুয়েক আগে গোপালগঞ্জে তাঁর ওপর হামলার চেষ্টা হয়েছিল, তখন তিনি বেঁচে যান। পুলিশের ধারণা, সেই শত্রুতারই প্রতিশোধ হতে পারে এই খুন।
সিসিটিভিতে ধরা পড়েছে দুষ্কৃতীরা
হাওড়া সিটি পুলিশের কমিশনার প্রবীণ কুমার ত্রিপাঠি জানিয়েছেন,
“ঘটনাস্থলের আশপাশের একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, একটি বাইকে দু’জন দুষ্কৃতী ঘটনাস্থলে আসে। একজন হেলমেট পরে ছিল, অন্যজন গুলি চালায়।”
এছাড়া পুলিশ স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করছে এবং ঘটনার সময় আশেপাশে কোনো সন্দেহজনক ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
চাঞ্চল্য এলাকায়, আতঙ্কে স্থানীয়রা
আলো-ঝলমলে পুজোর রাতে এমন শুটআউটের ঘটনা ঘটায় চমকে গেছেন স্থানীয়রা। বনবিহারী বসু লেনের দোকানপাটে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী রাজেশ ঘোষ বলেন,
“হঠাৎই তিনটে গুলির শব্দ শুনলাম। সবাই ছুটোছুটি শুরু করে। দেখি এক ব্যক্তি রাস্তায় পড়ে আছেন রক্তাক্ত অবস্থায়।”
পুজোর ভিড়ে ভরা এলাকায় এমন ঘটনার পর স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও আতঙ্কে দোকান বন্ধ করে দেন। অনেকেই দাবি করছেন, পুজোর সময় নিরাপত্তা আরও বাড়ানো উচিত ছিল।
বিহার যোগ খতিয়ে দেখছে পুলিশ
পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন,
“এই খুনের সঙ্গে বিহারের অপরাধচক্রের যোগ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুরনো শত্রুতার সূত্র ধরেই তদন্ত এগোচ্ছে।”
ঘটনাস্থলে ফরেনসিক দল এসে নমুনা সংগ্রহ করেছে। দুষ্কৃতীদের ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
পুজোর মাঝেই দুষ্কৃতী আতঙ্ক
মহাষ্টমীর রাত, যখন শহরজুড়ে চলছিল আরতি ও উৎসবের উচ্ছ্বাস—তখনই এই রক্তাক্ত ঘটনা ঘুম কেড়ে নিয়েছে সাধারণ মানুষের। হাওড়া সিটি পুলিশের এক সিনিয়র অফিসার বলেন,
“এত ব্যস্ত সময়ের মধ্যে এভাবে হামলা চালানো দুষ্কৃতীদের সাহসিকতারই প্রমাণ। তদন্ত দ্রুত শেষ করে অভিযুক্তদের ধরার চেষ্টা চলছে।”
স্থানীয়রা বলছেন, বনবিহারী বসু লেন সাধারণত ভিড় এলাকা। সেখানে এভাবে গুলি চালিয়ে পালানো সহজ নয়। তবে বাইকে করে দ্রুত পালিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। পুলিশের একাধিক দল এখন হাওড়া ও সংলগ্ন এলাকায় তল্লাশি চালাচ্ছে।
মহাষ্টমীর রাতে পুজোর আনন্দকে ছাপিয়ে গেল রক্তাক্ত সন্ত্রাস। ব্যবসায়ী সুরেশ যাদবের মৃত্যু ঘিরে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। পুরনো শত্রুতা নাকি নতুন প্রতিশোধ—সব দিক খতিয়ে দেখছে হাওড়া সিটি পুলিশ। এখন প্রশ্ন একটাই—বিজয়ার উৎসবের মাঝেই কে বা কারা এই মৃত্যুর নীলনকশা এঁকেছিল?
