দুর্গাপূজার দশমীর আনন্দঘন দিনেও রাজনীতির উত্তাপ ছড়ালো পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে নারাজ তৃণমূল কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। বৃহস্পতিবারের শোভাযাত্রা উপলক্ষে দুই দলই বালুরঘাট থানা মোড়ে পাশাপাশি পৃথক মঞ্চ তৈরি করায় এলাকাজুড়ে দেখা দেয় রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও উত্তেজনা।
শোভাযাত্রা শুরুর আগেই পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, সে কারণে ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয় বিশাল পুলিশবাহিনী। ডিএসপি পদমর্যাদার এক আধিকারিকের নেতৃত্বে মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য, সিভিল ফোর্স ও গোয়েন্দা ইউনিট। পুলিশ প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকার কারণেই শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়।
দুই মঞ্চে দুই শক্তির উপস্থিতি
বিজেপির মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বালুরঘাটের সাংসদ ড. সুকান্ত মজুমদার, জেলা সভাপতি স্বরূপ চৌধুরীসহ অন্যান্য স্থানীয় নেতৃত্ব। অন্যদিকে, তৃণমূলের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দলের মহিলা সভানেত্রী স্নেহলতা হেমব্রম, বালুরঘাট পুরসভার চেয়ারম্যান অশোক মিত্র, টাউন সভাপতি সুভাষ চাকি প্রমুখ।
দুই দলই নিজেদের মঞ্চ থেকে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের ঠান্ডা পানীয়, জল ও শুকনো খাবার বিতরণ করে। কিন্তু এই উদ্যোগ নিয়েই শুরু হয় বিতর্ক। বিজেপি অভিযোগ তোলে, তৃণমূলের মঞ্চ থেকে রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া হয়েছে—যা শোভাযাত্রার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অশোভন ও উস্কানিমূলক।
অভিযোগ-প্রত্যঅভিযোগে উত্তপ্ত বালুরঘাট
বিজেপির সাংসদ সুকান্ত মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন,
“তৃণমূলের মঞ্চ থেকে ‘খেলা হবে’ ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া হয়েছে, যা স্পষ্টভাবে উস্কানির উদ্দেশ্যে করা। তারা চেয়েছিল, বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা উত্ত্যক্ত হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাক, যাতে প্রশাসন আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এটা নোংরা রাজনীতির চূড়ান্ত উদাহরণ।”
অন্যদিকে, তৃণমূলের টাউন সভাপতি সুভাষ চাকির পাল্টা দাবি,
“বিজেপিই আসলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে রাজনীতির মঞ্চ বানিয়েছে। সাংসদ সুকান্ত মজুমদার একাধিক ক্লাবকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছেন। ওটাই তো প্রকৃত রাজনীতি। আমরা শুধু শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছি, কোনো উস্কানি দিইনি।”
এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসন বারবার দুই পক্ষের নেতাদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানায়।
পুলিশ প্রশাসনের সতর্ক ভূমিকা
বালুরঘাট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা বলেন,
“দুই দলের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হলেও আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। পুরো এলাকা সিসিটিভির আওতায় রাখা হয়েছিল। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বালুরঘাটের এই শোভাযাত্রা প্রতিবছরই বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এবারের অনুষ্ঠান নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উত্তেজনার নতুন বার্তা দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এই ঘটনাই ভবিষ্যৎ রাজনীতির তাপমাত্রা পরিমাপের ‘লিটমাস টেস্ট’।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় বাসিন্দারা এই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখে হতাশা প্রকাশ করেছেন। বালুরঘাট কলেজের অধ্যাপক সুব্রত ঘোষ বলেন,
“ধর্মীয় উৎসবকে রাজনৈতিক প্রদর্শনের মঞ্চ বানানো ঠিক নয়। মানুষ এখানে আনন্দ উপভোগ করতে আসে, রাজনীতির লড়াই দেখতে নয়।”
আরেক স্থানীয় ব্যবসায়ী মনোজ দত্ত বলেন,
“দশমীর দিন রাজনীতি না করে বরং একসাথে শান্তির বার্তা দেওয়া উচিত ছিল দুই দলের। কিন্তু এখানে উল্টোটা ঘটেছে।”
নির্বাচনের আগাম ইঙ্গিত
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনাটি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগাম ‘ওয়ার্ম-আপ’। উভয় দলই এখন থেকেই নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা রাখতে মাঠে নামছে। বালুরঘাটের ঘটনাই দেখিয়ে দিল, আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক সংঘর্ষ কতটা তীব্র হতে পারে।
বালুরঘাটের দশমীর শোভাযাত্রা এবার ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক ‘দড়ি টানাটানির’ প্রতীক হয়ে উঠল। দুই ফুল—গেরুয়া আর ঘাসফুল—কেউ কাউকে এক ইঞ্চিও ছাড়তে নারাজ। সামনে নির্বাচন, উত্তাপ কেবল বাড়বে—এটাই এখন সাধারণের ধারণা।
