ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আজ রঙ, রেখা ও ভাবনার উৎসবে রূপ নিয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল গ্যালারিতে শুরু হয়েছে ‘এ গ্রুপ আর্ট এক্সিবিশন’ শীর্ষক পাঁচ দিনব্যাপী এক ব্যতিক্রমধর্মী শিল্প প্রদর্শনী। অনুষদের ৫০তম ব্যাচের (১৯৯৭–৯৮ সেশন) শিল্পীদের এই আয়োজন যেন দুই দশকেরও বেশি সময়ের বন্ধুত্ব, শিল্পচর্চা ও সৃজনী যাত্রার এক পুনর্মিলন।
শুক্রবার বিকেলে জয়নুল গ্যালারি-১–এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অধ্যাপক ফরিদা জামান। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি ও চিত্রশিল্পী জাহিদ মুস্তাফা। উদ্বোধনী আয়োজনে চারুকলা অনুষদের শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিল্পানুরাগী এবং বিপুল দর্শক সমাগমে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
শিল্পের ভাষায় সময় ও সমাজ
২৩ জন শিল্পীর ৪৬টি শিল্পকর্মে সাজানো এই প্রদর্শনী যেন রঙের ভেতর দিয়ে সময় ও সমাজের কথকতা। প্রতিটি চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে মানুষের অনুভব, প্রকৃতির মায়া এবং মানবতার বোধ। কেউ আঁকছেন মাতৃভূমির নদীভরা দৃশ্য, কেউবা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার মানুষের মুখে প্রতিরোধের আলো।
প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণীয় কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘ব্লাড অ্যান্ড ব্লসমস (১,২)’, ‘হুইস্পার অফ টাইড’, ‘হুইস্পার অফ সাইলেন্স’, ‘মায়া’, ‘বাংলার বধু’, ‘প্রকৃতি’, ‘বৃক্ষ কথন’, ‘দুর্গার বিয়ে’, ‘দ্য লাস্ট রিডার অব পোয়েট্রি’, ‘দ্য গার্ডেনার’, ‘অপেক্ষা’, ‘সৃষ্টির ছন্দ’ এবং ‘রেডিয়েন্স ইন দ্য ডার্ক’।
এসব কাজের মধ্যে কোথাও নরম রঙে মিশে আছে গভীর মানবিক বোধ, কোথাও বা বিমূর্ততার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে সময়ের প্রতিবাদ। শিল্পীরা জানিয়েছেন, এই প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য হলো “শিল্পের মাধ্যমে অনুভবের বিনিময় ও মানবিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।”
শিল্পাচার্যের উত্তরাধিকার ও নতুন প্রজন্মের কণ্ঠ
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ফরিদা জামান বলেন,
“চারুকলা অনুষদের শিল্পীরা সব সময়ই সমাজ, প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। আজকের এই প্রদর্শনীতে আমি সেই ঐতিহ্যেরই পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। এই তরুণ-তরুণীরা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উত্তরাধিকার বহন করছে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও নতুন ভাষায়।”
তিনি আরও বলেন, “এই প্রদর্শনী আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শিল্প শুধু সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়, এটি প্রতিবাদেরও ভাষা। এখানে প্রতিটি ক্যানভাসে সময়ের স্পন্দন স্পষ্ট।”
অতিথি চিত্রশিল্পী ও কবি জাহিদ মুস্তাফা তাঁর বক্তব্যে বলেন,
“এই প্রদর্শনীতে আমি দেখেছি শিল্পীরা নিজের অভিজ্ঞতা, সমাজের অনুষঙ্গ এবং মানবতার আকুতি একসঙ্গে মিশিয়ে তুলেছেন। এটি শুধু প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলন নয়, বরং শিল্পচর্চার এক পুনরাবিষ্কার।”
শিল্পীর কণ্ঠে অনুভবের গল্প
প্রদর্শনীর আয়োজক শিল্পীদের একজন বলেন,
“আমাদের ব্যাচের সবার কাজের ধরন আলাদা, কিন্তু শিল্পচিন্তা এক জায়গায় মিলে গেছে—মানুষ ও জীবনের প্রতি ভালোবাসায়। আমরা চেষ্টা করেছি, শিল্প যেন দর্শকের সঙ্গে এক ধরনের কথোপকথনে যুক্ত হয়।”
একজন অংশগ্রহণকারী শিল্পী যোগ করেন, “আমার কাজ ‘ব্লাড অ্যান্ড ব্লসমস’ মূলত যুদ্ধ ও মানবতার বিপরীত বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। রক্তপাতের মধ্যেও জীবনের ফুল ফুটে ওঠে—এই আশাই আমার চিত্রের বিষয়।”
দর্শনার্থীদের উচ্ছ্বাস ও প্রতিক্রিয়া
প্রদর্শনী দেখতে আসা দর্শনার্থীরা জানান, একাধিক থিমের সংমিশ্রণে এই আয়োজনটি ব্যতিক্রম। কেউ বিমূর্ততায় মুগ্ধ, কেউ বাস্তবধর্মী কাজের রঙ ও আলোছায়ায় হারিয়ে গেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ বলেন,
“এখানে প্রতিটি ক্যানভাসে একটা গল্প আছে। গাজার যন্ত্রণা থেকে বাংলার প্রকৃতি—সবই যেন আমাদের সময়ের প্রতিফলন।”
প্রদর্শনী চলবে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত
পাঁচ দিনব্যাপী এই শিল্প প্রদর্শনীটি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত শিল্পাচার্য জয়নুল গ্যালারি-১ এ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ৭ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে এ আয়োজন।
প্রদর্শনীর আয়োজকরা আশা করছেন, এটি শুধু চারুকলা অনুষদের শিল্পীদের নয়, বরং পুরো দেশের শিল্পপ্রেমীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে—যেখানে রঙের ভেতর দিয়ে ফুটে উঠবে বাংলার জীবন, মাটি, মানুষ ও মানবিকতার বোধ।
