ডিমেনশিয়া সাধারণত বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রংশের সমস্যা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কেবল বার্ধক্য নয়, বংশগত কারণ এবং কিছু দৈনন্দিন অভ্যাসও এ রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পাঁচ কোটির বেশি মানুষ ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন। এর মধ্যে আলঝেইমারস রোগ সবচেয়ে জটিল এবং দুরারোগ্য ধরনের একটি, যা স্মৃতি, চিন্তা ও দৈনন্দিন কাজের দক্ষতা ধীরে ধীরে হ্রাস করে।
তবে আশার কথা হলো, জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগ প্রতিরোধ বা ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে ডিমেনশিয়ার আক্রান্তের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব।
মানসিক স্বাস্থ্য ও সৃজনশীলতা বজায় রাখা
মানসিক প্রশান্তি এবং সৃজনশীল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে কার্যকর। যেমন—
- ঘর পরিষ্কার করা : ঘর গোছানোর মতো সাধারণ কাজও মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও অবসাদ কমাতে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মন ভালো রাখে এবং দীর্ঘমেয়াদে স্মৃতিশক্তি রক্ষা করে।
- বাগানের কাজ : গাছের পরিচর্যা মানসিক চাপ কমানোর পাশাপাশি শরীর ও মনকে সতেজ রাখে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কের ওপরও। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
- রান্না করা : রান্না একটি সৃজনশীল কাজ। সবজি কাটা, মশলা বাছাই, স্বাদ মিলিয়ে রান্না করার মতো কাজ মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। একইসঙ্গে এটি মনোযোগ বাড়ায় এবং নতুন কিছু শেখার আগ্রহ জাগিয়ে রাখে।
শারীরিক কার্যক্রমের গুরুত্ব
শরীর সুস্থ না থাকলে মস্তিষ্কও সুস্থ থাকে না। তাই নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমানোর সবচেয়ে সহজ উপায়গুলোর একটি।
- হাঁটা : প্রতিদিন অন্তত ৮ থেকে ১০ হাজার পা হাঁটার লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত। হাঁটা শুধু মাংসপেশি ও হাড়ের জোর বাড়ায় না, বরং ওজন নিয়ন্ত্রণ, হৃদ্যন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করা এবং ভালো ঘুম নিশ্চিত করে।
- সঙ্গী নিয়ে হাঁটা : একা হাঁটার তুলনায় বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের কারও সঙ্গে হাঁটা অনেক বেশি আনন্দদায়ক। এতে সামাজিক বন্ধনও শক্ত হয়, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- স্মৃতিশক্তি উন্নত করা : গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, যা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সহায়ক। একই সঙ্গে মন ভালো থাকে ও দুশ্চিন্তা কমে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম
শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়মিত ব্যায়াম (ব্রিদিং এক্সারসাইজ) মস্তিষ্ক ও শরীর উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বড় করে শ্বাস নেওয়া ও ছাড়া, বিশেষত নাক দিয়ে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে শরীর বেশি অক্সিজেন পায় এবং মানসিক চাপ হ্রাস পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, “যে কোনো ব্যায়াম করার সময় শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হলে বুঝতে হবে ব্যায়ামটি সঠিকভাবে হচ্ছে না।” তাই শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ম ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।
সামাজিক সম্পৃক্ততা ও ইতিবাচক জীবনধারা
ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে সামাজিক সংযোগ বজায় রাখাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধু বা আত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটানো, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া এবং নতুন কিছু শেখার চেষ্টা মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। পাশাপাশি ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
ডিমেনশিয়া এখনো পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়, তবে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। প্রতিদিনের জীবনে শারীরিক ব্যায়াম, সৃজনশীল কাজ, সামাজিক সংযোগ ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখলে এ রোগ প্রতিরোধে অনেকটাই সাফল্য পাওয়া যায়।
সহজ করে বললে— প্রতিদিন হাঁটুন, মনকে ব্যস্ত রাখুন, ইতিবাচকভাবে বাঁচুন— তাতেই কমবে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি।
লেখক: মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডারস বিশেষজ্ঞ
