ভাষাসংগ্রামী, প্রাবন্ধিক, কবি ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ আহমদ রফিক আর নেই। বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) রাত ১০টা ১২ মিনিটে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
আহমদ রফিকের বিশেষ সহকারী মো. রাসেল গণমাধ্যমকে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, মৃত ঘোষণা করার সাত মিনিট আগে তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এর আগে বুধবার বিকেলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। কিডনির জটিলতা ও একাধিকবার ‘মাইল্ড স্ট্রোক’-এর কারণে কয়েক মাস ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন।
দীর্ঘ চিকিৎসা, অবনতিশীল স্বাস্থ্য
গত ১১ সেপ্টেম্বর ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর তাঁকে প্রথমে পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় পরে তাঁকে বারডেমে স্থানান্তর করা হয়। বারডেম হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. কানিজ ফাতেমার তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। তবে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটায় চিকিৎসকরাও তাঁকে আর সুস্থ করে তুলতে পারেননি।
২০১৯ সাল থেকে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে শুরু করে। অস্ত্রোপচার করেও দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ২০২৩ সাল থেকে তিনি প্রায় দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন। এছাড়া ২০২১ সালে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থার ক্রমাবনতি শুরু হয়।
এক সংগ্রামী জীবন
আহমদ রফিক ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি শুধু সরাসরি অংশগ্রহণই করেননি, আন্দোলনের ইতিহাস রচনার অন্যতম প্রামাণ্য প্রাবন্ধিক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা শতাধিক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর গবেষণা বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
২০০৬ সালে স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি একাই বসবাস করতেন ঢাকার নিউ ইস্কাটনের গাউসনগরের ভাড়া বাসায়। নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। তবে একাকীত্ব তাঁর সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার মনোযোগে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
রবীন্দ্রচর্চায় অনন্য অবদান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন, সাহিত্য ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার ওপর আহমদ রফিকের কাজ দুই বাংলায় বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। কলকাতার টেগর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাঁকে প্রদান করে “রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য” উপাধি। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। তাঁর গ্রন্থে উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিকতা, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার গভীর ব্যাখ্যা।
বিদায়বেলায় মহান সিদ্ধান্ত
নিজের মৃত্যু পরবর্তী দেহ ব্যবহারের ব্যাপারেও মানবসেবায় অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন আহমদ রফিক। জীবদ্দশাতেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ চিকিৎসাশাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজে দান করবেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল মেডিকেল কলেজে দেহ দান করে গেছেন তিনি।
বিদগ্ধ সমাজের শোক
আহমদ রফিকের মৃত্যুতে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষাঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর অবদান স্মরণ করেছে। অনেকেই মনে করেন, ভাষা আন্দোলন ও রবীন্দ্রচর্চার ইতিহাস লিখতে গেলে আহমদ রফিকের নাম অবধারিতভাবে উচ্চারিত হবে।
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একবার তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন, “আহমদ রফিক আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে শুধু লিপিবদ্ধ করেননি, তিনি সেটিকে বোধ ও চেতনায় রূপ দিয়েছেন।”
এক যুগের সমাপ্তি
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ইতিহাসবিদ ও রবীন্দ্রতত্ত্বচর্চার প্রধানতম ব্যক্তিত্ব আহমদ রফিকের প্রয়াণে শেষ হলো এক প্রজ্ঞার যুগ। তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্য, গবেষণা ও আন্দোলনের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পথ দেখাবে।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited