বাংলাদেশজুড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা এবারও এক বিশেষ আবহ তৈরি করেছে। আজ সোমবার মহাসপ্তমীর পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আরাধনায় ভক্তরা ভরিয়ে তুলেছেন সারাদেশের পূজামণ্ডপ।
আচার-অনুষ্ঠানে আধ্যাত্মিক আবহ
সকালের প্রথম প্রহর থেকেই শুরু হয় সপ্তমীর মূল আচার। দেবীর প্রতীকী স্নান করানো হয় আয়নায় প্রতিবিম্ব ফেলে। এরপর অনুষ্ঠিত হয় নবপত্রিকা স্থাপন, যা প্রচলিত ভাষায় কলাবৌ স্নান নামে পরিচিত।
এই আচার শেষে দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠার অন্যতম অংশ চক্ষুদান সম্পন্ন হয়। ভক্তরা ফুল, বেলপাতা, ধূপ-দীপ হাতে নিয়ে দেবীর চরণে অঞ্জলি দেন এবং শান্তি, সমৃদ্ধি ও সুরক্ষার প্রার্থনা করেন।
ঢাকের বাদ্য, কাঁসর ঘণ্টা ও শঙ্খধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে মণ্ডপগুলোতে সৃষ্টি হয় আধ্যাত্মিক এক পরিবেশ।
পূজামণ্ডপে উৎসবের রঙ
রাজধানীর পাশাপাশি বিভাগীয় শহর ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও আজ ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ।
ঢাকার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন মঠসহ প্রতিটি পূজামণ্ডপেই ভক্তদের ঢল নামে। সেখানে শুধু পূজা নয়, ছিল ভক্তিমূলক সংগীতানুষ্ঠান, বস্ত্র বিতরণ, মহাপ্রসাদ ও আরতি প্রতিযোগিতা।
শিশু থেকে প্রবীণ—সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে পূজামণ্ডপগুলো রূপ নেয় মিলনমেলায়।
নিরাপত্তায় কঠোর নজরদারি
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারা দেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কেবল ঢাকা মহানগরীতেই মণ্ডপের সংখ্যা ২৫৮টি।
শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, যা সার্বক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
আগমন ও গমন: শুভ-অশুভের প্রতীক
এ বছর দেবী দুর্গা গজে (হাতি) আগমন করেছেন। হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাসে এটি শান্তি, শস্য-শ্যামলা বসুন্ধরা ও সমৃদ্ধির প্রতীক।
তবে দেবীর দোলায় (পালকি) গমনকে অশুভ সংকেত হিসেবে ধরা হয়, যা দুর্যোগ বা মহামারির ইঙ্গিত বহন করে।
আগামীকাল মহাষ্টমী ও কুমারী পূজা
আগামীকাল মঙ্গলবার মহাষ্টমী। দিনটির মূল আকর্ষণ হবে কুমারী পূজা, যা ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে অনুষ্ঠিত হবে। এখানে এক কুমারী কন্যার মধ্যেই প্রতিফলিত করা হবে দেবী দুর্গাকে। হাজারো ভক্ত সমবেত হয়ে দেবীর ঐশ্বরিক শক্তি আরাধনা করবেন।
ভক্তদের অনুভূতি
রাজধানীর এক পূজামণ্ডপে উপস্থিত পূণ্যার্থী শর্মিষ্ঠা দেবী বলেন,
“মহাসপ্তমী মানেই ভক্তি ও আনন্দের মিলন। দেবীর চরণে অঞ্জলি দিতে পারাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে এখানে এসে একাত্ম হতে পেরে হৃদয় ভরে গেছে।”
অন্যদিকে তরুণ স্বেচ্ছাসেবক অভিষেক দত্ত জানান,
“আমরা দিন-রাত কাজ করছি পূজার নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে। ভক্তরা যেন নির্বিঘ্নে পূজা করতে পারেন, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য।”
উৎসবের ধারাবাহিকতা
গতকাল মহাষষ্ঠী দিয়ে শুরু হয়েছে দুর্গোৎসবের মূল পর্ব। আগামী ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে দেবী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই সার্বজনীন উৎসব।
ভক্তরা বিশ্বাস করেন, দেবী দুর্গার আগমন কেবল ধর্মীয় অনুশ্ঠান নয়, এটি শান্তি, সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যের বার্তাও বহন করে। এবারের মহাসপ্তমী কেবল একটি পূজা নয়, বরং ছিল এক আনন্দঘন মিলনমেলা, যেখানে মিলে গেছে আচার, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও উৎসবের আবহ।
