বাংলাদেশের খাদ্য সংস্কৃতিতে এক অমূল্য সংযোজন ‘নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি’। সম্প্রতি এই মিষ্টি পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জি.আই) পণ্যের স্বীকৃতি। এর ফলে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টান্ন শুধু নেত্রকোণার নয়, হয়ে উঠলো বাংলাদেশেরও এক বিশেষ পরিচয়বাহী সম্পদ।
বালিশ কেন?
আকারে ছোট হলেও দেখতে অনেকটা বালিশের মতো হওয়ায় এ মিষ্টির নামকরণ ‘বালিশ’। এর গায়ে ক্ষীর বা দুধের মালাইয়ের প্রলেপ থাকায় মনে হয় যেন আবরণে মোড়ানো নরম বালিশ। স্থানীয়ভাবে এ মিষ্টি পরিচিত ‘গয়ানাথের বালিশ’ নামেও।
উৎসবের অপরিহার্য অংশ
বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ, দুর্গাপূজা কিংবা নতুন জামাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে আগমনের মতো যেকোনো উৎসবে বালিশ মিষ্টির উপস্থিতি অপরিহার্য। শুধু জেলার বাসিন্দাই নয়, দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণপিয়াসীরাও নেত্রকোণায় এসে এই অনন্য মিষ্টির স্বাদ নিতে ভুল করেন না। বিদেশে যাওয়া অনেকেই প্রিয়জনের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে যান নেত্রকোণার বালিশ।
তৈরির কৌশল
বালিশ মিষ্টি তৈরি হয় দেশি গাভির খাঁটি দুধ-ছানা, ময়দা ও চিনি দিয়ে। প্রথমে ছানার সঙ্গে সামান্য ময়দা মিশিয়ে মন্ড তৈরি করা হয়। সেখান থেকে বানানো হয় বালিশ আকৃতির মিষ্টি। এরপর গরম চিনির রসে ভিজিয়ে রাখা হয় অনেকক্ষণ, যাতে ভেতর পর্যন্ত মিষ্টি টইটম্বুর হয়ে ওঠে। বিক্রির সময় মিষ্টির ওপরে দেয়া হয় দুধের ক্ষীর বা মালাই। কারিগররা দাবি করেন, কিছু বিশেষ প্রক্রিয়া রয়েছে যা তারা বাণিজ্যিক গোপনীয়তার কারণে প্রকাশ করেন না।
দাম ও আকৃতি
বালিশ মিষ্টি পাওয়া যায় ৩০, ৫০, ১০০, ৩০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার পিসে। বড় আকারের মিষ্টি একা খাওয়ার মতো নয়—এক হাজার টাকার একটি বালিশ মিষ্টি অনায়েসে ৫–৬ জন ভাগাভাগি করে খেতে পারেন।
ঐতিহ্যের জনক গয়ানাথ ঘোষ
নেত্রকোণার বারহাট্টা রোডে শত বছর আগে গয়ানাথ ঘোষ এই মিষ্টির উদ্ভাবন করেন। ক্রেতাদের উৎসাহে নাম দেন ‘বালিশ’। দ্রুতই মিষ্টিটি সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে উদ্ভাবকের নামের সঙ্গে মিষ্টির নামও জড়িয়ে যায়—‘গয়ানাথের বালিশ’।
১৯৬৫ সালে গয়ানাথ ঘোষ কলকাতায় চলে যাওয়ার সময় মিষ্টান্ন ভান্ডারটি বিক্রি করে দেন তার প্রধান কারিগর নিখিল মোদকের কাছে। বর্তমানে নিখিলের তিন ছেলে—বাবুল, দিলীপ ও খোকন মোদক—দোকানটি পরিচালনা করছেন। তাদের দাবি, নেত্রকোণা ছাড়া কোথাও এই প্রতিষ্ঠানের শাখা নেই এবং অনলাইনেও তারা বালিশ মিষ্টি বিক্রি করেন না।
জি.আই স্বীকৃতিতে গর্ব
নেত্রকোণার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, “বালিশ মিষ্টি নেত্রকোণার পরিচয়ের অংশ। জি.আই স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আগেই আমরা বিজয়পুরের সাদামাটি জি.আই স্বীকৃতি পেয়েছিলাম, এবার বালিশ মিষ্টিও যুক্ত হলো সেই তালিকায়।”
লোকজ সংস্কৃতিতে বালিশ মিষ্টি
এই মিষ্টি এতটাই জনপ্রিয় যে তা লোকজ ছড়া, কবিতা, এমনকি সাহিত্যেও স্থান করে নিয়েছে। যেমন—
“জাম, গোল্লা পেয়ে শ্বশুর করলো চটে নালিশ,
কথা ছিল আনবে জামাই নেত্রকোণার বালিশ।”
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখাতেও এসেছে এ মিষ্টির উল্লেখ। স্থানীয় কবি সঞ্জয় সরকার লিখেছেন—
“নগদ টাকায় কাজ হয় না
হয় না তেল মালিশে
বসের মন তুষ্ট করে নেত্রকোণার বালিশে।”
জনপ্রিয়তার শীর্ষে আজও
বর্তমানে বারহাট্টা রোডের গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার প্রতিদিন উপচেপড়া ক্রেতায় ভরে থাকে। পাশাপাশি স্টেশন রোড ও মেছুয়া বাজারে তাদের আরও দুটি শাখা রয়েছে। জেলার বাইরেও নেই কোনো শাখা, ফলে বালিশ মিষ্টির স্বাদ নিতে হলে সরাসরি নেত্রকোণায়ই আসতে হবে।
