অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করার সম্পূর্ণ নতুন নিয়ম: আর নয় ভোগান্তি!
ইউনিয়ন পরিষদের দিন শেষ, এখন ঘরে বসেই জন্ম নিবন্ধন
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করার কথা ভাবছেন? একটা সময় ছিল যখন সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ (UP) সদস্য বা চেয়ারম্যানের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয় হয়ে যেত। দিনের পর দিন ঘুরেও সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় এই সনদটি হাতে পাওয়া ছিল এক বিরাট ঝামেলার কাজ। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়ায় সেই ভোগান্তির দিন এখন শেষ।
এখন আর কারো পেছনে ঘুরতে হবে না। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে চালু হয়েছে ডিজিটাল সেন্টার এবং সরকারিভাবে খোলা হয়েছে অনলাইন সার্ভিস। আপনি এখন আপনার এলাকার দোকানে, ডিজিটাল সেন্টারে অথবা নিজের স্মার্টফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করে ঘরে বসেই আপনার নিজের বা শিশুর অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করতে পারবেন। এই আর্টিকেলে আমরা ধাপে ধাপে পুরো প্রক্রিয়াটি আলোচনা করবো, যাতে আপনি খুব সহজেই কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন।
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন কেন জরুরি এবং কী কী কাজে লাগে?
জন্ম নিবন্ধন একজন নাগরিকের প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এটি না থাকলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। যেমন:
- সন্তানের বিদ্যালয়ে ভর্তি
- পাসপোর্ট তৈরি করা
- জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) বানানো
- বিবাহ নিবন্ধন
- জমি ক্রয়-বিক্রয়
- ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা
- সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে আবেদন
- উত্তরাধিকার সনদ получение
সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে জন্ম নিবন্ধন সনদ অপরিহার্য। তাই শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যেই জন্ম নিবন্ধন করা প্রত্যেক অভিভাবকের দায়িত্ব।
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
আবেদনের পূর্বে কিছু কাগজপত্র প্রস্তুত রাখতে হবে। আবেদনকারীর বয়সের উপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ভিন্নতা রয়েছে।
নবজাতক (বয়স ০ থেকে ৪৫ দিন)
- শিশুর ইপিআই টিকা কার্ডের সত্যায়িত ফটোকপি।
- হাসপাতালে জন্ম হলে হাসপাতাল থেকে প্রদত্ত ছাড়পত্র।
- পিতা ও মাতার অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদের কপি।
- পিতা ও মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) কপি।
- হোল্ডিং ট্যাক্স বা বাড়ির চৌকিদারি কর পরিশোধের রশিদের কপি।
শিশু (বয়স ৪৬ দিন থেকে ৫ বছর)
- শিশুর স্বাস্থ্যকর্মীর প্রত্যয়নপত্র ও ইপিআই টিকা কার্ডের সত্যায়িত ফটোকপি।
- পিতা ও মাতার অনলাইন জন্ম নিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি।
- বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের রশিদের কপি।
- প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ডাক্তারের প্রত্যয়নপত্র।
৫ বছরের বেশি বয়সী যে কারো জন্য
- শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র (PSC/JSC/SSC)।
- পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি (যদি থাকে)।
- পিতা ও মাতার অনলাইন জন্ম নিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি।
- বাড়ির কর পরিশোধের রসিদ।
- জমির দলিলের কপি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
ধাপে ধাপে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করার প্রক্রিয়া
নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে আপনি সহজেই অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করতে পারবেন।
ধাপ ১: অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রবেশ প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অফিসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে। এর জন্য আপনার ব্রাউজারে টাইপ করুন: http://bdris.gov.bd/br/application
H3: ধাপ ২: ঠিকানা নির্বাচন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার পর আপনাকে জন্ম নিবন্ধনের আবেদনটি কোন ঠিকানা থেকে করতে চান তা নির্বাচন করতে বলা হবে। আপনি যার জন্য আবেদন করছেন তার জন্মস্থান, স্থায়ী ঠিকানা বা বর্তমান ঠিকানার যেকোনো একটি নির্বাচন করে “পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপ ৩: আবেদনপত্র পূরণ এই ধাপে একটি বড় ফরম আসবে। নির্ভুলভাবে সব তথ্য পূরণ করতে হবে।
- ব্যক্তির তথ্য: আবেদনকারীর নাম বাংলা ও ইংরেজিতে (নামের প্রথম ও শেষ অংশ), জন্ম তারিখ, লিঙ্গ, পিতা ও মাতার কততম সন্তান তা উল্লেখ করুন।
- পিতা ও মাতার তথ্য: পিতা ও মাতার নাম বাংলা ও ইংরেজিতে, তাদের জন্ম নিবন্ধন নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিন।
- ঠিকানার তথ্য: জন্মস্থান, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানার সকল তথ্য (দেশ, বিভাগ, জেলা, উপজেলা/সিটি কর্পোরেশন, ইউনিয়ন/ওয়ার্ড, গ্রাম/পাড়া) সঠিকভাবে পূরণ করুন।
- সংযুক্তি: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (উপরে উল্লেখিত তালিকা অনুযায়ী) স্ক্যান করে বা ছবি তুলে সংযুক্ত করুন। ফাইলের আকার নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখতে হবে।
সকল তথ্য পূরণ করার পর “সংরক্ষণ” বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপ ৪: আবেদনপত্র প্রিন্ট ও জমা আবেদন সফলভাবে সাবমিট হলে আপনি একটি অ্যাপ্লিকেশন আইডি নম্বর পাবেন এবং আবেদনপত্রের একটি প্রিন্ট কপি ডাউনলোড করার অপশন পাবেন। আবেদনপত্রটি প্রিন্ট করে তার সাথে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্রের সত্যায়িত কপি সংযুক্ত করে আপনার নির্দিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন অফিসে জমা দিন।
জন্ম নিবন্ধন সম্পর্কিত অন্যান্য জরুরি অনলাইন সেবা
শুধু নতুন আবেদনই নয়, জন্ম নিবন্ধন সম্পর্কিত আরও অনেক সেবা এখন অনলাইনে পাওয়া যায়। আপনার সুবিধার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ লিংক নিচে দেওয়া হলো:
- জন্ম নিবন্ধন তথ্য সংশোধন: যদি আপনার সনদে কোনো ভুল থাকে, তবে এই লিংকে গিয়ে সংশোধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন: http://bdris.gov.bd/br/correction
- আবেদনের বর্তমান অবস্থা যাচাই: আপনার আবেদনটি কোন পর্যায়ে আছে তা জানতে এই লিংকে অ্যাপ্লিকেশন আইডি দিয়ে সার্চ করুন: http://bdris.gov.bd/br/application/status
- জন্ম নিবন্ধন তথ্য অনুসন্ধান: আপনার বা পরিবারের কারো জন্ম নিবন্ধন সনদ যাচাই করার জন্য এখানে যান: http://bdris.gov.bd/br/search
- আবেদনপত্র প্রিন্ট: সাবমিট করা আবেদনপত্র পুনরায় প্রিন্ট করতে চাইলে এই লিংক ব্যবহার করুন: http://bdris.gov.bd/application/print
- সনদ পুনঃ মুদ্রণ (Re-print): আপনার জন্ম নিবন্ধন সনদ হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে পুনরায় তোলার জন্য এখানে আবেদন করুন: http://bdris.gov.bd/br/reprint
শেষ কথা ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন এখন আর কোনো জটিল বিষয় নয়। উপরের নির্দেশনা অনুসরণ করলে আপনি কোনো প্রকার দালালের সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করতে পারবেন। এতে আপনার সময়, অর্থ এবং শ্রম তিনই বাঁচবে। আর নয় ঘুরাঘুরি, সেবা নিন নিজ পরিবারে থেকেই।
