অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিশ্বব্যাপী সংঘাত ও সংকট শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নকে গুরুতর হুমকির মুখে ফেলছে। তিনি বলেন, “আজকের পৃথিবী এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে—জলবায়ু পরিবর্তনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে, বৈষম্য বাড়ছে, সংঘাত বিস্তার লাভ করছে। ন্যায়বিচার ও শান্তির জন্য সংগ্রাম মানবতার বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আয়োজিত ‘সোশ্যাল বিজনেস, ইয়ুথ অ্যান্ড টেকনোলজি’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন।
পুরনো সমাধান যথেষ্ট নয়
ইউনূস বলেন, যুদ্ধ, বাস্তুচ্যুতি ও সীমান্ত অতিক্রম করা সঙ্কটগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ছিন্নভিন্ন করছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুরনো কূটনৈতিক পন্থা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন নতুন কূটনীতি, গভীর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতি সমষ্টিগত প্রতিশ্রুতি।
বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, দেশটি কঠিন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট, ঘন ঘন জলবায়ু বিপর্যয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলার মতো কঠিন বাস্তবতা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের বাজেট সংকোচন বা উন্নয়ন সহায়তা হ্রাস করা হবে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী পদক্ষেপ। বরং আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়াতে হবে।
নতুন অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বিদ্যমান বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে অপ্রতুল উল্লেখ করে ইউনূস বলেন, “যেখানে মানুষের চেয়ে মুনাফাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেখানে এসডিজি পূরণ সম্ভব নয়। প্রয়োজন এমন একটি অর্থনীতি, যেখানে মানুষের কল্যাণ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিবেশ সুরক্ষা মুনাফার চেয়ে বড় অগ্রাধিকার পাবে।”
তিনি সামাজিক ব্যবসাকে এই নতুন অর্থনীতির কেন্দ্রীয় ধারণা হিসেবে উল্লেখ করেন। এক ডলারের ক্ষুদ্র ঋণ থেকে শুরু হওয়া এ ধারণা আজ বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে শুরু করে খেলাধুলা পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে সামাজিক ব্যবসা প্রমাণ করছে যে মানবতার সমস্যার সমাধান করেও আর্থিকভাবে টিকে থাকা সম্ভব।
তরুণ প্রজন্মই নতুন সভ্যতার স্থপতি
ইউনূস বলেন, বর্তমান সভ্যতা সীমাহীন ভোগ, শোষণ ও সঞ্চয়ের ধ্বংসাত্মক পথে হাঁটছে, যা পৃথিবীকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। তাই প্রয়োজন নতুন সভ্যতা, যা লোভ নয় বরং মানবিকতা ও পরিবেশগত দায়িত্বশীলতায় পরিচালিত হবে। এ নতুন সভ্যতার স্থপতি হবে তরুণ প্রজন্ম।
তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “তোমাদের স্বপ্ন সীমাহীন। যেখানে স্বপ্ন নেতৃত্ব দেয়, সেখানেই উদ্ভাবন জন্ম নেয়। বড় স্বপ্ন দেখো, তবে তা বাস্তবায়নে আজই পদক্ষেপ নাও—কাল নয়।”
প্রযুক্তি : আশীর্বাদ না অভিশাপ?
প্রযুক্তির প্রসঙ্গে ইউনূস বলেন, বিশ্ব এখন নতুন প্রযুক্তিগত যুগের দ্বারপ্রান্তে—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও নানা উদ্ভাবন মানব অগ্রগতির ধারা পাল্টে দিচ্ছে। তবে প্রযুক্তি আশীর্বাদ হবে না অভিশাপ—তা নির্ভর করবে আজকের সিদ্ধান্ত ও আগামী দিনের নেতৃত্বে বপন করা মূল্যবোধের ওপর।
তিনি আহ্বান জানান, প্রযুক্তির ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে হবে বিবেক দিয়ে—প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার ভিত্তিতে, কিছু মানুষের জন্য নয়, বরং সবার জন্য।
শেষে তিনি বলেন, “আসুন নিশ্চিত করি, নতুন প্রযুক্তির যুগ হোক সহমর্মিতা, ন্যায়বিচার ও সমষ্টিগত অগ্রগতির যুগ।”
