নেত্রকোনা বাংলাদেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চলের এক অনন্য জেলা, যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং আদিবাসী জনপদের জীবনচিত্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের যথেষ্ট উপাদান ধারণ করে আছে, অথচ পর্যটনের উন্নয়নে নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতা, অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও যথাযথ প্রচারের অভাবে নেত্রকোনার পর্যটন খাত বছরের পর বছর ধরে ঘুমন্ত অবস্থায় রয়ে গেছে; দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরিতে বিরল চিনামাটির পাহাড়, সবুজ পাহাড় ঘেরা গারো অধ্যুষিত গ্রাম, সীমান্তঘেঁষা সোমেশ্বরী নদীর নীলচে স্রোতধারা, ও বুনো প্রকৃতির অনবদ্য উপস্থিতি যেমন প্রাকৃতিক পর্যটনের সম্ভাবনা তৈরি করে, তেমনি খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন ও বারহাট্টা উপজেলার বিস্তৃত হাওরাঞ্চল বর্ষায় রূপ নেয় এক অপার জলরাজ্যে, যেখানে হিজল-কড়ই গাছের ছায়ায় ভেসে বেড়ানো, মাছ ধরা, নৌবিহার, গ্রামীণ জীবন ও সূর্যাস্ত উপভোগ পর্যটকদের কাছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হতে পারে; এ জেলায় রয়েছে গারো ও হাজং সংস্কৃতি, লোকজ উৎসব, মুক্তিযুদ্ধ ও হাজং বিদ্রোহের নিদর্শন, যেমন—হাজং সংগ্রাম স্মৃতিস্তম্ভ, রাজা গোপাল পালের রাজবাড়ি, শেখেরগাঁও মসজিদ, ঠাকুর জোয়ানন্দের আখড়াসহ অগণিত প্রাচীন নিদর্শন, যেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও উপস্থাপন হলে শিক্ষাবান্ধব ও ইতিহাসভিত্তিক পর্যটনের ক্ষেত্রেও নেত্রকোনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে; অথচ রেল ও সড়ক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা, দুর্গম হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের ঝুঁকি, মানসম্পন্ন আবাসন ও খাদ্য ব্যবস্থার ঘাটতি, পর্যটক তথ্যকেন্দ্র ও দক্ষ গাইডের অনুপস্থিতি, টয়লেট ও বিশ্রামাগারের অনুপস্থিতি, এবং সর্বোপরি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার ফলে নেত্রকোনার পর্যটন আজ পর্যটকপ্রবণ জেলার তুলনায় অনেকটাই অনুন্নত, যদিও স্থানীয় জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণ সমাজ, এখনো স্বপ্ন দেখে তাদের সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও পরিবেশকে ঘিরে একটি স্বনির্ভর, পরিবেশবান্ধব পর্যটনখাত গড়ে তোলার, যা শুধু কর্মসংস্থানই নয়, এক ধরনের আত্মপরিচয়ের জায়গাও তৈরি করতে পারে; এই জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত পর্যটন মাস্টারপ্ল্যান, যাতে চিনামাটি পাহাড় ও সোমেশ্বরী নদীকে রক্ষা করে টেকসই পর্যটন স্থাপনা গড়ে তোলা যায়, প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে ইকো রিসোর্ট, হোম-স্টে ও স্থানীয় গাইড নিয়োগ, যা জেলার তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করবে এবং একই সঙ্গে নারীদের পর্যটন-নির্ভর হস্তশিল্প, খাদ্য ও সংস্কৃতি প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ঘটাবে; ‘ জেলা পর্যটন প্ল্যাটফর্ম, স্যোশাল মিডিয়া প্রচারণা, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে উৎসব আয়োজন—যেমন ‘হাওর উৎসব’, ‘বিরিশিরি বর্ষামেলা’, ‘গারো সংস্কৃতি সপ্তাহ’ বা ‘লোকসংস্কৃতি উৎসব’—চালু করতে পারলে নেত্রকোনা নিজেকে তুলে ধরতে পারবে একটি পরিপূর্ণ পর্যটন ব্র্যান্ড হিসেবে, পাশাপাশি শিক্ষা, গবেষণা ও পরিবেশ সংরক্ষণকেও এই পর্যটনের অংশ করে নিতে হবে যাতে একে শুধু বিনোদনের খাত নয়, বরং এক ধরনের দায়িত্বশীল সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে দেখা যায়, যেখানে স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা, প্রশাসনিক সদিচ্ছা, পরিবেশগত সতর্কতা এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অঙ্গীকার মিলেই এক নতুন সম্ভাবনার পথ তৈরি করবে, যেখানে নেত্রকোনার পাহাড়, নদী, হাওর ও মানুষ—সব মিলিয়ে গড়ে উঠবে এক জীবন্ত, চলমান, টেকসই পর্যটন জেলা, যা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সক্ষম হবে।
লেখক :মোঃ নাজমুল ইসলাম (সাংবাদিক ও কলামিস্ট)