ইস্তিগফার মানে হল আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং অসীম দয়ালু। তিনি বলেন, আল্লাহর কাছে তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু [সূরা নিসা : আয়াত ১০৬]। আর আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনার জন্য ইস্তিগফার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি একটি উত্তম আমল।
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও তিনি বলেন— ‘আল্লাহর কসম, আমি দিনের মধ্যে ৭০ বারেরও অধিক ইস্তিগফার এবং তওবা করে থাকি। [সহিহ বুখারি : ৬৩০৭]।
ইস্তিগফার সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে আছে— ‘অথচ আল্লাহ কখনই তাদের ওপর আজাব নাজিল করবেন না যতক্ষণ আপনি তাদের মাঝে অবস্থান করবেন। তা ছাড়া তারা যতক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে আল্লাহ কখনো তাদের ওপর আজাব দেবেন না।’ [সুরা আনফাল, আয়াত: ৩৩]
ইস্তিগফার কীভাবে করতে হয়?
ইস্তিগফার অনেকভাবে করা যায়। সবচেয়ে ছোট ইস্তিগফার أَستَغْفِرُ اللهَ
উচ্চারণ : ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’
অনুবাদ : আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
প্রতি ওয়াক্তের ফরজ সালাতে সালাম ফিরানোর পর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এই দোয়া ৩ বার পড়তেন। [মিশকাত-৯৬১]
আবার,
أسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذي لا إلهَ إِلاَّ هُوَ الحَيَّ القَيُّومَ وأتُوبُ إلَيْهِ
উচ্চারণ : ‘আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাজি লা- ইলা-হা ইল্লা- হুওয়া হাইয়্যুল কইয়্যূম ওয়া আতূবু ইলায়হি’।
অনুবাদ : আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, তিনি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন মা‘বূদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং তাঁর কাছে তাওবাহ্ করি [আবু দাউদ-১৫১৭] পড়েও ইস্তিগফার করা যায়। তবে সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ ইস্তিগফার। এবং এটি সকাল সন্ধ্যার জিকির।
সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার :
اَللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّىْ لآ إِلهَ إلاَّ أَنْتَ خَلَقْتَنِىْ وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّمَا صَنَعْتُ، أبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ وَأَبُوْءُ بِذَنْبِىْ فَاغْفِرْلِىْ، فَإِنَّهُ لاَيَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা আনতা রব্বি লা-ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্কতানি ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আহ্দিকা ওয়া ও’য়াদিকা মাসতাত’তু আ’উযুবিকা মিন শার্রি মা ছা’নাতু আবূউলাকা বিনি’মাতিকা আ’লাইয়্যা ওয়া আবূউলাকা বিযানবী ফাগফিরলি ফাইন্নাহু লা-ইয়াগফিরুয্যুনূবা ইল্লা আনতা।
অনুবাদ: হে আল্লাহ! তুমিই আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের ওপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নিয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। কারণ তুমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবে না।
যে ব্যক্তি সকালে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ ইস্তিগফার পড়বে আর সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সে মারা যাবে, সে জান্নাতি হবে। আর যে ব্যক্তি রাতে পড়ে সকালের আগে মারা যাবে, সে জান্নাতি হবে। [বুখারী-৬৩০৬]
ইস্তিগফার কেন প্রয়োজন?
কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘আর আমি তাদের বলেছি, তোমাদের রবের কাছে ইস্তিগফার করো; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল। (তোমরা ইস্তিগফার করলে) তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। আর তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ এবং সন্তানসন্ততি দিয়ে। তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত নদীমালা [সুরা নুহ, আয়াত : ১০-১২]
ইস্তিগফার নিয়ে একটি ঘটনা
ইস্তিগফার নিয়ে চমৎকার একটি ঘটনা পাওয়া যায় ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহর জীবনীতে। জগৎ বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ সারা জীবন হাদিস সংগ্রহে কাটিয়ে দিয়েছেন। একবার তিনি শামের একটা শহর হয়ে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে ইশার সালাতের ওয়াক্ত হয়ে গেলে তিনি কাছের এক মসজিদে ঢুকলেন সালাত আদায়ের জন্য। যেহেতু রাত হয়ে গেছে এবং তাকে অনেক দূর যেতে হবে, তাই তিনি চিন্তা করলেন ফজরের নামাজ পড়েই এ মসজিদ থেকে বিদায় গ্রহণ করবেন। তিনি সালাত আদায় করে মসজিদে বসে থাকলেন। তাকে সালাতের পরও মসজিদে বসে থাকতে দেখে মসজিদের দ্বাররক্ষী এসে বললেন, রাতে মসজিদে থাকা যাবে না। মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনু হাম্বল অনেক বিনয়ের সঙ্গে বলার পরও মসজিদের দ্বাররক্ষী শুনলেন না। নিরুপায় হয়ে তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে পড়লেন। মসজিদের বাইরেই ছিল একটা রুটির দোকান।
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ যুবক দোকানদারকে সালাম দিয়ে বললেন, হে যুবক! শীতের রাত, আমি কি তোমার কাছে আগুন পোহাতে পোহাতে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারি? দোকানদার যুবক বললেন, ‘আহলান, ওয়া সাহলান! আপনাকে স্বাগতম। এটা আমার খোশ নসিব। আপনি এখানে আগুন পোহাতে পোহাতে রাত কাটিয়ে দিলে আমার সমস্যা কী? মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনু হাম্বল চুলার কাছে বসে বসে হাদিস পড়া শুরু করে দিলেন। কিন্তু তিনি যুবকের একটা জিনিস লক্ষ্য করলেন যে- যুবক রুটি খামির তৈরি করতে বলেন, ‘আসতাগফিরুল্লাহ’, বেলুন দিয়ে রুটি বানাতে গিয়ে বলেন, ‘আসতাগফিরুল্লাহ’, ক্রেতার হাতে রুটি তুলে দিতে গেলে বলেন, ‘আসতাগফিরুল্লাহ’, টাকা নিতে গিয়েও বলেন, ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ অর্থাৎ সব কাজেই যুবকটি শুধু পড়ছে, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’। যুবকের ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়ার এ বিষয়টি দেখে মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনু হাম্বলের কৌতুহল বেড়ে গেল। তিনি ভাবনায় পড়ে গেলেন। তিনি হাদিসের কিতাব বন্ধ করে যুবককে বললেন, হে যুবক! আমি আসার পর থেকেই দেখছি আপনি কিছুক্ষণ পর পর শুধু পড়ছেন- ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’। কেন আপনি এত বেশি ইস্তেগফার করছেন?
এবার যুবক বলল, এটা আমার চিরাচরিত আমল। এ আমলটা আমি সব সময় করে থাকি। আমি সব সময় ইস্তেগফারের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকি। আর এ আমলের ফলে আল্লাহ তাআলা আমাকে ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’ বানিয়ে দিয়েছেন। আমি দোয়া করলেই তা কবুল হয়ে যায়। এ জীবনে আমি হাত তুলে যত দোয়া করেছি, যখনই আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি, আল্লাহ তাআলা তা কবুল করে নিয়েছেন। যুবকের এ কথা শুনে মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনু হাম্বল একেবারেই অবাক। তিনি যুবককে আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’? আপনি দোয়া করলেই কবুল? যুবক বললেন, ‘হ্যাঁ’, আমি দোয়া করলেই কবুল। তবে আমার একটা দোয়া এখনো কবুল হয়নি। সেটি ছাড়া আল্লাহ আমার সব দোয়া কবুল করে নিয়েছেন।
এবার ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ’র আগ্রহ-কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। তিনি যুবককে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার সে দোয়াটা কী? যা এখনো কবুল হয়নি। এবার যুবক রুটিওয়ালা বললেন, আমার যে দোয়াটা কবুল হয়নি, আমি আল্লাহর কাছে অনেকবার দোয়া করেছি যে, হে আল্লাহ! আমি শুনেছি এ জামানার সবচেয়ে বড় মুহাদ্দিস, তার নাম ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল। আল্লাহ তোমার কাছে আমার আকুতি ও মিনতি, আমি যেন এত বড় মুহাদ্দিস-এর হাতে হাত রেখে মোসাফাহ করতে পারি আর তাঁর কপালে একটা চুম্বন করতে পারি।’ আমার এ দোয়া এখনো পূরণ হয়নি।
এবার মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনু হাম্বল আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন। আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। এবং কান্না বিজড়িত গলায় যুবককে বললেন- ‘আপনার কবুল না হওয়া দোয়াটাও আজ কবুল হলো, ভাই। আপনার সম্মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনিই আহমাদ ইবনু হাম্বল। নিশ্চয় আপনার দোয়ার কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর বান্দা আহমাদকে আপনার দোরগোড়ায় টেনে এনেছেন’।
সুবহানাল্লাহ! এই হচ্ছে ইস্তিগফারের ফল। আল্লাহ তায়া’লা ইস্তিগফারের কারণে তাঁর বান্দার সকল চাওয়া পূরণ করে দেন। তাই আমাদের উচিত দুনিয়া এবং আখিরাতের কল্যাণের জন্য সারা দিন ইস্তিগফার দিয়ে নিজেদের জিহ্বা ভিজিয়ে রাখা।