বহু প্রতীক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’ আজ শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। বিকেল ৪টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এই ঐতিহাসিক সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ সময় উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, কূটনীতিক ও শিক্ষাবিদরাও অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে শেষ প্রস্তুতি
বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি পর্যালোচনা করতে একটি জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন এবং সনদের মূল ধারাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাত সদস্যের এই কমিটি গত তিন মাস ধরে সনদ প্রণয়ন ও আলোচনার কাজ সম্পন্ন করেছে। সনদের খসড়া ইতোমধ্যেই দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়, এবং অধিকাংশই এতে নীতিগত সম্মতি জানিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
রাজনৈতিক ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা
৪০ পৃষ্ঠার এই সনদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিক রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—
- ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক পটভূমি,
- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন,
- ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন,
- ১৯৬৬ সালের ছয় দফা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন,
- এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান।
এছাড়া সনদে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭৫ সালের সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একদলীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গও বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
গণতন্ত্রের উত্থান ও স্থবিরতার ইতিহাস
সনদের এক অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, “বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাবলির পর ১৯৭৮ সালে বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে শুরু হওয়া ১৯৭৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ গণতন্ত্রে ফিরে আসে। তবে সেই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা স্বল্পস্থায়ী ছিল।”
পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসন, দলীয় আধিপত্য, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বারবার বিঘ্নিত হয়—এমন পর্যবেক্ষণও সনদে উঠে এসেছে।
২০০৯–২০২৪: স্বৈরাচারী অনুশীলনের অধ্যায়
সনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়কে ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক দখলদারিত্বের যুগ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়,
“এই সময়কালে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোতে নির্দিষ্ট ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধি পায়, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করেছে।”
তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন—২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪—কে সনদে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সনদে দাবি করা হয়েছে, এসব নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া দুর্বল হয়েছে এবং রাজনীতির ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে।
জনআন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও জুলাই বিপ্লবের প্রতিফলন
সনদে ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত একাধিক গণআন্দোলন ও নাগরিক প্রতিবাদের ধারা তুলে ধরা হয়েছে—যার মধ্যে রয়েছে সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, ছাত্র–জনতার নেতৃত্বাধীন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ ২০২৪ সালের জুলাই মাসের বৃহৎ গণঅভ্যুত্থান।
সনদে বলা হয়, এই ধারাবাহিক গণজাগরণই ২০২৪ সালের জুলাইয়ে “ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের বিজয়” এনে দেয়, যা বর্তমান জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।
গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য সাত দফা প্রতিশ্রুতি
‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’-এর শেষ অধ্যায়ে রয়েছে সাতটি দফা প্রতিশ্রুতি, যা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সংস্কার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত।
এই দফাগুলোয় বলা হয়েছে—
- সব রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক নীতিমালা মেনে চলবে,
- রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা হবে,
- এবং জনগণের ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হবে।
সনদে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে এ সাত দফায় সই করে জাতীয় ঐক্যের প্রতিশ্রুতি প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন ঐকমত্যের অধ্যায় সূচনা করতে পারে। তাঁদের ভাষায়, এটি কেবল একটি দলিল নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নির্ধারণে একটি দিকনির্দেশক মাইলফলক হতে পারে।
আজকের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে সেই নতুন যাত্রা—গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও জাতীয় ঐক্যের পথে।








সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited