রূপকথায় তো কতকিছুই সম্ভব। অলৌকিক কত ঘটনাই মেনে নিতে হয়। কিন্তু দিন শেষে রাজা-রানীর দুঃখ থামে, হাসি ফুটে তাদের মুখে। দানব-দৈত্যের পরাজয়ে সুখে সমাপ্তির ব্যাপারটি চলে আসে সবসময়। এমিলিয়ানো মার্তিনেজের জীবনটা রূপকথার চেয়ে কম কিসের। ২০১১ সালে ১৭ বছর বয়সে সিনিয়র ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করেন, একই বছর ডাক পান আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে। কিন্তু ২০২১ পর্যন্ত তার ম্যাচ খেলার সংখ্যা শুনলে চোখ কপালে উঠবে যে কারো। এই সময়ে ক্লাবে ১০৯ ম্যাচ খেলা স্টপার জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ৬টিতে। অবিশ্বাস্যভাবে একের পর এক উপেক্ষা সত্ত্বেও মনবল ধরে এগিয়েছেন এমি মার্তিনেজ। যেন রূপকথার ওই একলা রাজার মতো, শতকষ্টেও হীরকের আশায় দুর্গম পথে এগিয়ে যাওয়া। মার্তিনেজের জন্য দুর্গম পথ এই উপেক্ষা, ক্যারিয়ার জুড়েই যা সহ্য করে এসেছেন। আর পুরষ্কার, অন্ধকার পথের শেষের আলো ২০২১ কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে। যেখানে কলম্বিয়ার সঙ্গে টাইব্রেকারে তিন-তিনটি শট বাচিয়ে আর্জেন্টিনাকে তুলে দেন ফাইনালে। পেনাল্টি সেভের জন্য নাম হয়ে যায় তার বাজপাখী। মারাকানায় পরে ব্রাজিলকে হারিয়ে শিরোপায় জেতে মেসি-মার্তিনেজরা।
আর্জেন্টিনার এক নম্বর গোলরক্ষক তখন ফ্রাঙ্কো আরমানি। কিন্তু করোনা পজিটিভ হওয়ায় ওই কোপা আমেরিকায় ছিলেন না রিভারপ্লেটের স্টপার। এই সুযোগে ক্যারিয়ারের প্রথমবার আর্জেন্টিনার জার্সিতে টানা ম্যাচ খেলার সুযোগ পান এমি মার্তিনেজ। কোপায় খেলেন ৬ ম্যাচ। খেলেননি শুধু বলিভিয়ার সঙ্গে ম্যাচ।
১০ বছর আগে ২০১১ সালে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে প্রথমে ডাক পেয়েছিলেন এমি জাতীয় দল। কিন্ত সাইডবেঞ্চেই বসে থাকতে হয় তাকে। দ্বিতীয়বার ডাক পান ৮ বছর পর ২০১৯ সাল জার্মানি ও ইকুয়েডরের বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচে। সেবারও সুযোগ হয়নি সেরা একাদশে খেলার। আরো দু’বছর অপেক্ষার পর গত ৪ জুন চিলির বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে তারপর কলোম্বিয়ার সঙ্গেও ৪০ মিনিট খেলার ইনজুরির কারণে উঠে যেতে বাধ্য হন। এরপর আরমানির করোনা পজিটিভ এই কোপায় তার খেলার সুযোগ করে দেয়।
এ তো গেল জাতীয় দলে তার উপেক্ষার কথা। ক্লাবের হিসাবটা মার্তিনেজের জন্য আরো কষ্টের। আর্জেন্টিনার ক্লাব ইন্দিপেন্দিয়েন্তের একাডেমি থেকে উঠে আসা এ গোলরক্ষক তরুন বয়সেই ইউরোপে খেলার স্বপ্ন দেখেন। প্রিয় ক্লাব আর্সেনাল। তাই ছুটে যান ক্লাবটিতে ট্রায়াল দিতে। ১৭ বছর বয়সে ট্রায়ালে টিকেও যান। এক বছর ক্লাবটির যুব দলে খেলে ২০১২ সালে সুযোগ পান মূল দলে। কিন্তু অদ্ভুত কারণে মার্তিনেজকে অবজ্ঞা করে গানার্সরাও। তার ওপর আস্থাই রাখেনি। তাই অক্সফোর্ড ইউনাইটেড, শেফিল্ড ওয়েনসডে, রোথারহ্যাম ইউনাইটেড, উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্স, রিডিং এবং স্পেনের গেটাফের কাছে সময়ে সময়ে ধারে বিক্রী করেছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ে আর্সেনালের জার্সিতে মাত্র ১৫টি ম্যাচ খেলেছেন মার্তিনেজ। ক্লাবটির প্রতি ভালবাসা রেখে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘এখনও আর্সেনালের সব কিছু ভালোবাসি আমি এবং খেলাও দেখি তাদের। তবে আমার মনে হয়, আমাকে যেমন বিশ্বাস করার কথা তেমনটা বিশ্বাস আর্সেনাল আমার ওপর রাখত না।’ সত্যিই বিশ্বাস রাখেনি আর্সেনাল, গোলরক্ষক বার্নড লেনোর ইনজুরির কারণে সুযোগ পেয়েছিলেন ২০১৯-২০ মৌসুমে। সুযোগের সদ্যবহার করে একের পর এক অবিশ্বাস্য সেভ দিয়ে পারফরম্যান্সের দ্যুতি ছড়ান। তবুও ওই মৌসুম পর অ্যাস্টন ভিলার কাছে মার্তিনেজকে বিক্রীই করে দেয় আর্সেনাল। তাতে অবশ্য এই আর্জেন্টাইনের সেরা পর্যায়ে ম্যাচ না খেলার আক্ষেপটা ঘোচে। ভিলার গোলরক্ষক হিসেবে খেলেছেন মোট ৩৮ ম্যাচ। দক্ষ গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করে মধ্যম মানের ভিলাকে লিগে ১১তম হতে সাহায্য করেন। ১৫ ম্যাচে জাল অক্ষত রেখে ক্লাব রেকর্ড গড়েন। ২০২০-২১ মৌসুমে সমর্থকদের ভোটে অ্যাস্টনভিলার সেরা ফুটবলারও হন।
সেই সাফল্যটা আর্জেন্টিনার জার্সিতে নিয়ে আসে মার্তিনেজকে। টানা সুযোগ পেয়ে ২০২১ কোপায় ছাড়িয়ে যান নিজেকে। বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন নিজের সামর্থ্য। ঠিক যেন ১৯৯০ বিশ্বকাপের সার্জিও গায়কোচিয়া। আর্জেন্টিনার সাবেক ওই কিপারও বেঞ্চ থেকে হঠাৎ সুযোগ পেয়ে বিস্ময় পারফর্ম করেছিলেন। ওই আসরের পেনাল্টি সেভের নায়ক হয়ে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে পৌছতে ভূমিকা রাখেন। কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে যথাক্রমে যুগোস্লাভিয়া ও স্বাগতিক ইতালির বিপক্ষে টাইব্রেকারে অবিশ্বাস্য সাফল্য দেখান গায়কোচিয়া। সেই গায়কোচিয়াকে মনে করালেন মার্তিনেজ। আরমানির জায়গায় সুযোগ পেয়ে গায়কোচিয়ার মতো পেনাল্টি সেভের রাজা হয়ে উঠলেন। কোপায় চিলির বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচে পেনাল্টি সেভ করেছিলেন। এরপর সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে তিনটি। কাতার বিশকাপের ফাইনালেও টাইব্রেকারে ফ্রান্সের কিংসলে কোমানের শট বাচিয়ে নায়ক হয়ে যান এমি মার্তিনেজ। স্বীকৃতি মেলে বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপারের।