একবার ডানে,একবার বামে এভাবে কয়েকবার মাথা নাড়িয়েই থেমে গেল।আঁটকে রইল মেহগনি গাছের মগডালে।এটি ছিল একটি ঘুড়ি। ঘুড়িটির নাম ছিল চিল ঘুড়ি যা গ্রামে বলা হয় ‘চিলে ঘুড়ি’।ধান কেটে চাষীরা ঘরে তুলেছে।ধান গাছের নিচের কিছু অংশ এখনও মাঠে দেখা যাচ্ছে। দেখা যাওয়ারই কথা, এবার ভালো রোদ
হয়েছে তাই সবাই বিচুলি করতে পেরেছে। বিচুলি করতে এক-দুই ইঞ্চি মাটির উপর থেকে কেটেছে ধান।সেই মাঠে বেলা তখন দুপুর সকালের মাঝামাঝি, ঘুড়ি ও একটা পাটকাঠিতে খানিকটা সুতো হাতে এলো একটা বালক।বয়স আর কত হবে?ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে এমন ১২ বা ১৩ বছর।একটু পরই আকাশে উড়তে দেখা গেল একটা চিল ঘুড়ি। ঘুড়িটা নিজ হাতে খবরের কাগজ দিয়ে বানানো।পরম যত্নে,যেন কত মমতা, কত স্বপ্ন ওই ঘুড়িতে।আর একটু আপসোস, ইশ!আমি যদি ঘুড়ি হতাম!ঘুড়িটি যে দামি নয় তা দেখলেই বোঝা যায়। দোকান থেকে কিনতে গেলে কয়েকশ টাকা নিবে।কিন্তু ওত টাকা দিয়ে ঘুড়ি কিনবে কি করে?তাইতো মায়ের ঝাড়ু বানানোর জন্য রেখে দেওয়া নারিকেল শলা,আব্বার বাজার থেকে আনা খবরের কাগজ আর গ্রামের জঙ্গলের গাছ থেকে নিয়ে আসা একধরনের আঠা যা গ্রামে ‘বল আঠা’ বলা হয় তাই দিয়েই ছোট ছোট বালকসুলভ হাতে বানানো ঘুড়িটি।আর একধরনের ঘুড়িও আছে যা বানাতে বাঁশের কঞ্চির শলা দরকার হয়।যেই ঘুড়িটির নাম ‘ ডাক ঘুড়ি ‘ বলা হয়।এই ঘুড়ি বানানোর শ্রম বেশি ও উড়ানোর সুতো মজবুত হতে হয়।এটা সাধারণত কিছু কিছু উৎসব ও বিশেষ দিনে উড়ায়।তখন রোদ বেশ প্রখর হয়েছে। দুপুরের নাওয়া – খাওয়া বাদ দিয়ে বালকটি তখনও ঘুড়ির সুতো ছেড়ে চলেছে।সুতো ওতোটাও ভালো ভালো নয়,মায়ের কাঁথা সেলাইয়ের জন্য এনে রাখা একটা বান্ডিল। ঘুড়িটি মাথা নাড়িয়ে, লেজ আঁকা বাকা করে ক্রমশই দূর আকাশে উড়তে লাগলো।তবে ঘুড়িটি অনেক গুলো সুতো অপচয় করছে।যে সুতোয় ঘুড়িটি অনেক দূর যেতে পারতো, সেই সুতো এটি অনেকটা মোটা মানুষের পেটের মতো বানিয়েছে।ছেলেটি মনে মনে রাগ করলো, এতো সুতো নষ্ট করার দরকার কি?সে সুতোসহ পাটকাঠি একটি গাছে বাঁধল।ভাবলো একটু হেঁটে আসলে মন্দ হয়না।বালকটি যখন হাঁটতে গেল তখনই ঘুড়িটি সুতোয় টান টের পেল।এবার সে মাথা নাড়িয়ে ও লেজ আঁকা বাকা করে দ্রুত উড়তে ব্যস্ত হয়ে গেল।হঠাৎই জোরে হাওয়া শুরু হয়েছে।বালকটি ছুটলো তার ঘুড়ি দেখতে।কিন্তু হায়!তা ততক্ষণে সুতো ছিঁড়ে বাতাসের সাথে অদূরে উড়ে যেতে লাগল।বালকটি তার ঘুড়ি ধরতে ছুটলো তার পিছু পিছু।কিন্তু অবশেষে শেষ রক্ষা হলো না।ঘুড়িটি তার মাথা একবার পূর্বে,একবার পশ্চিমে এভাবে দুলতে দুলতে গাছের মাথায় আঁটকে গেল।সাথে ভেঙে গেল একটা বালকের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন তাকে উড়তে অনুপ্রেরণা দিত,তাকে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে শিখাচ্ছিল।আমাদের জীবনকে ঘুড়ির মতো মুক্ত আকাশে উড়তে দিতে হবে, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের সুতো বা নাড়ির টান,আমাদের পরিবারকে।